
গত ১০ এপ্রিল বগুড়া আদালত চত্বর থেকে মোটরসাইকলে চুরির সিসি ক্যামেরা ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবি
নিজ বাসার সামনে থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি মোটরসাইকেল চুরি হয় বগুড়া শহরের মালতিনগরের বাসিন্দা জাহিদ হাসানের। এখনও কোনো সন্ধান মেলেনি।
জাহিদের আক্ষেপ মামলা করতে চাইলে তাও নেয়নি পুলিশ। পরে চুরির ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হন তিনি।
পেশায় ঠিকাদার ব্যবসায়ী জাহিদ দাবি করেন, অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ থাকায় চুরির মামলা নেয়নি থানা পুলিশ।
জয়যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে আসে, শুধু শহরের মালতিনগর এলাকাতেই দুই মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) অন্তত পাঁচটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। যার একটিরও কোনো হদিস পায়নি পুলিশ।
যদিও বগুড়া সদর থানা পুলিশের দাবি, সদর উপজেলা মিলে চলতি বছরে মাত্র ১০ টি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে।
তবে মোটরসাইকেল চুরি হওয়ার ঘটনা স্বীকার করলেও মামলা নথিভুক্ত করার কোনো রেকর্ড নেই। চোরাই মোটরসাইকেলগুলো উদ্ধারে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতাও নেই।
পুলিশ বলছে, বেশকয়টি মোটরসাইকেলের চুরি হওয়ার সিসি ফুটেজ পেয়েছে। কিন্তু কাউকে শনাক্ত করা যায় নি। বাইরের চোর চক্র বগুড়ায় এসে মোটরসাইকেল চুরি করে চলে যাচ্ছে বলেই কাউকে ধরা সম্ভব হচ্ছে না, দাবি পুলিশের।
মোটরসাইকেল চুরি হওয়া জাহিদ হাসানের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হয় এ নিয়ে। তার অভিযোগ, মোটরসাইকেল যদি চুরি হয় তবে মামলা কেন হবে না? আর মামলা যদি নাই নিয়ে থাকে তবে এর প্রতিকার কী? অবশ্য এর কোনো প্রতিকার পুলিশও দিতে পারেনি।
আলাপকালে জাহিদ জানান, একটি মোটরসাইকেল ক্রয় করার সময় সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স পরিশোধ করা হয়। আবার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ দিয়ে নিবন্ধন করছে মোটরসাইকেল মালিক। যখন একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়, তাতে কারও কি দায় থাকবে না?
জাহিদের ভাষ্য, তার মোটরসাইকেল চোর অন্য কোনো জেলায় নিয়ে বিক্রি করছে। সেটি কিনে আরেক মানুষ ব্যবহার করছে। কিন্তু মামলা না থাকার কারণে এই মোটরসাইকেল শনাক্তের কোনো চিহ্ন থাকছে না।
মালতিনগরের আরেক বাসিন্দা পরিবহন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিপন জাহিদের প্রতিবেশী। গত ১৯ মার্চ তার বাড়ির সামনে থেকে মোটরসাইকেল চুরি হয়। মোটরসাইকেলটির মালিক রিপনের জামাই একরামুল বিন নাছির। তিনি বগুড়ার রাডার স্টেশনে চাকরি করেন।
এই চুরির পর সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করেন রিপন। সেগুলো পুলিশকে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। রিপন জানান, তাকেও থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অনেকটা ‘জোর জবরদস্তি’ করার পর পুলিশ অভিযোগ নিয়েছে।
রিপন বলেন, দুসপ্তাহের ব্যবধানে আমার জামাইয়েরটা নিয়ে এলাকায় অন্তত চারটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। থানায় মামলা করতে গেলেও তারা নিতে চান না। কেন মামলা নেয় না তাও ঠিক করে বলে না পুলিশ!
তার আক্ষেপ, শহরে চোর ঘুরছে। কিন্তু সেটি নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো মাথা ব্যথা নেই। মামলা দিতে চাইলে নেয় না। জিডি করলে তার পরবর্তী পদক্ষেপ জানা যায় না। তাহলে নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?
খোঁজ করতে গিয়ে আরও একজনের মোটরসাইকেল চুরির খবর পাওয়া যায়। এই ব্যক্তির নাম আব্দুর রশিদ। বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া এলাকার বাসিন্দা, চাকরি করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে।
২৫ ফেব্রুয়ারি ঠনঠনিয়া ভাই পাগলার মাজার মসজিদ থেকে মোটরসাইকেল চুরি হয়। শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়ার সময় আব্দুর রশিদ মোটরসাইকেলটি মসজিদের ভিতরে রাখেন। নামাজ শেষে এসে দেখেন মোটরসাইকেলটি নেই।
থানায় গেলে পুলিশ আব্দুর রশিদকে আগে ঘটনাস্থলে যেতে বলেন। সেখানে এক কর্মকর্তা উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত দেখে তাকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললে তখন থানায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
থানায় গেলে একইভাবে মামলা নিতে চায়নি। এক পর্যায়ে রশিদকে সাধারণ ডায়েরি করতে বলা হয়। পরে জিডি করে চলে আসেন তিনি। এই ঘটনাও শুধুমাত্র কাগজের জিডিতেই আটকে আছে।
আব্দুর রশিদ বলেন, মোটরসাইকেল পাওয়ার আশা আমি এখনও করি না। তবে আমার মোটরসাইকেল ব্যবহার করে যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন আমাকেই দায়ী করা হবে। সেই বিষয় থেকে থানায় জিডি করা।
তবে রশিদের মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা জিডি করেই শেষ হয়নি। তাকে বেশি অবাক করেছে জিডি করে থানা থেকে বের হয়ে আধা কিলোমিটার পথ আসার পরই।
আব্দুর রশিদ বলেন, সন্ধ্যার দিকে জিডি করে থানা থেকে বের হয়ে মফিজ পাগলার মোড়ে আসি। সেখানে আমার দু জন সহকর্মী ছিলেন। মোড়ে আসতেই আমার মোবাইলে একজন কল দেন। রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে আমার মোটরসাইকেলের নম্বর উল্লেখ করে বলেন, গাড়ি ফেরত চাই কিনা।
আমি যখন বললাম ফেরত তো অবশ্যই চাই। এ কথা শুনে মোবাইলের অপর পাশের ব্যক্তি ২৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু মোটরসাইকেল ফেরত পাওয়ার পরে টাকা দিব বলতেই সম্ভব না বলে লাইন কেটে দেন।
বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশকে জানান আব্দুর রশিদ। পুলিশের পরামর্শে ওই নম্বরে তিনি নিজেই কল দেন। দিয়ে মোটরসাইকেলের ছবি চান। কিন্তু সেটিও সম্ভব নয় বলে কল কেটে দেয় অপরিচিত ফোনদাতা।
আব্দুর রশিদ বলেন, নম্বরটি ট্র্যাক করলে সিমকার্ডের মালিকের ঠিকানা রংপুর দেখায়। এরপর আর তার সঙ্গে কথা হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত এই তিন ব্যক্তির মোটরসাইকেল চুরির তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন বনানী ফাঁড়ির এসআই সাজ্জাদুল ইসলাম। তিনি জানান, চুরির ঘটনায় আমরা সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। সেগুলোতে যাদের দেখা গেছে; খোঁজ খবর করছি। কিন্তু কাউকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
এ কয়টি ঘটনা ছাড়াও শহরের মফিজ পাগলার মোড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে মোটরসাইকেল চুরির খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়াও মার্চ মাসে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুটি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা রয়েছে। ১০ এপ্রিল আদালত চত্বর থেকে মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক আইনজীবীর মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। এই চুরি সিসিটিভি ফুজেটও রয়েছে।
বগুড়া সদর থানায় মোটরসাইকেল চুরির পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান নেই বলে দাবি ওসি সেলিম রেজার। গত তিন মাসে ১০টি মোটরসাইকেল চুরির জিডি ও অভিযোগ পেয়েছে বলে জানান তিনি। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা অন্তত ২০ টি হওয়ার মতো খবর পাওয়া গেছে পুলিশ ও স্থানীয়দের কাছে থেকে।
সেলিম রেজা বলেন, অনেকে চুরির পর থানায় অভিযোগ দেন না। এ জন্য সঠিক হিসাব পাওয়া দুষ্কর।
মামলা না নেয়ার বিষয়ে ওসি বলেন, সাধারণত এমন হওয়ার কথা নয়। থানায় কেউ মামলা করতে আসলে সেটি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া আছে।
অবশ্য মোটরসাইলে চুরি বিষয়ে মামলা না নেওয়ার নজির গত কয়েক বছর ধরেই ঘটছে। বগুড়ার এক থানার সাবেক ওসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মোটরসাইকেল চুরি তো হয়-ই। কিন্তু পুলিশ এটি মামলা হিসেবে নথিভূক্ত করতে চায় না। কারণ চুরির মামলা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি প্রকাশ পায়। এই দায় পুলিশ এড়াতে চায়।
জেলা পুলিশ বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাইরের জেলার লোকজন এসে মোটরসাইকেল চুরি করে থাকে। এ জন্য তাদের ধরা সম্ভব হয় না।
সদর থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাধারণত চোরচক্র মোটরসাইকেল চুরি করে সোনাতলা উপজেলা হয়ে বাইরের জেলায় চলে যায়। এ ছাড়া আরও একটি পথ তারা ব্যবহার করে। সেটি শিবগঞ্জ বা দুপচাঁচিয়া উপজেলা হয়ে জয়পুরহাটের হিলির দিকে যায় চোরচক্র। কিন্তু জেলায় এই চোরচক্রের আশ্রয় বা মদদদাতা বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।
জানতে চাইলে মোটরসাইকেল হারানোর ঘটনায় মামলার পাশাপাশি উদ্ধারও হয় বলে দাবি করেন জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী। তবে বগুড়া সদর প্রায় গত এক বছরে মোটরসাইকেল উদ্ধার হওয়ার কোনো খবর নেই।
পুলিশ সুপার বলেন, মোটরসাইকেল হারিয়ে গেলে থানায় মামলা রুজু করতে হবে। এবং শুধু মামলা করলেই হবে না, তা উদ্ধার করতে হবে। রাজশাহীতে রেঞ্জ মিটিংয়ে এসব নিয়ে কথা হয়েছে। মাসিক অপরাধ সভাতেও আলোচনা করা হয়।
সুদীপ কুমার আরও বলেন, প্রত্যেক থানায় মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একটি টিমকে এ কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে।