Joy Jugantor | online newspaper

যমুনার বালুচরে কৃষি বিপ্লবের জয়গান

খোরশেদ আলম

প্রকাশিত: ০১:০৯, ২১ ডিসেম্বর ২০২২

যমুনার বালুচরে কৃষি বিপ্লবের জয়গান

ছবি- জয়যুগান্তর

গাইবান্ধার ফুলছড়ি চরের ঘেটু মণ্ডলের বয়স ৬৫ পেরিয়ে গেছে। তার জীবনের পুরোটা কেটেছে কৃষি, মাটি আর পানির সাথে যুদ্ধ করে। জীবনের তাগিদেই খাদ্য উৎপাদনে নিজেকে মগ্ন রেখেছেন।

সনাতনী চাষবাদ পদ্ধতিতে আঁকড়ে থাকা ঘেটু মণ্ডল জীবন সায়াহ্নে এসে কৃষিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন। চরের অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেই প্রান্তিক এই মানুষ আট বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ ফসল ফলিয়ে কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করছেন।

প্রবীণ কৃষক ঘেটু মণ্ডলের এমন কৃষি বিপ্লবের নেপথ্যে সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশ সরকার যৌথ উদ্যোগ কাজ করছে। চরের কৃষি আর জীবনমান উন্নয়নে অর্থায়ন করছে তারা। এখানে বসবাসকারী দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে শরীয়তপুর, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, এবং জামালপুরে। এই ছয় জেলাই যমুনার তীরে অবস্থিত।

'মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দি চরস (এমফোরসি)' নামক প্রকল্প এলাকার বসবাসকারী মানুষের আয় ১৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়; সেখানে কৃষি, পশুপালন, নার্সারিসহ উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আগামী ২০২৪ সালে শেষ হবে।

চর জীবিকায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সুইস কনট্যাক্ট ও বগুড়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ)। চরে বসবাসকারী দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে দ্বিতীয় ধাপে ৫৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এতে ছয় জেলার ২৮ উপজেলার চরাঞ্চলের ৭৯ হাজার মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তাদের একজন হলেন ঘেটু মণ্ডল।

ঘেটু মণ্ডল আট বছর আগে যে জমিতে প্রতি বিঘায় ১৫ মণ ভুট্টা উৎপাদন করেছেন সেখানে এখন ৩০ থেকে ৩৫ মণ পর্যন্ত উৎপাদিত হচ্ছে। তার এক বিঘা জমিতে এখন ১০ থেকে ১৩ মণ মরিচ (শুকনো) ফল হয়। অথচ আট বছর আগে একই পরিমাণ জমিতে তার ৪ থেকে ৫ মণ মরিচ উৎপাদিত হয়েছে।

গাইবান্ধার ফুলছড়ি চরে চেয়ারম্যান বাজারে বসে ঘেটু মণ্ডল জানালেন, "চরে এখন ভুট্টা, শশা, মরিচ, ঢেঁড়শ, ধানসহ বিভন্ন প্রকার শাক উৎপাদনে দারুণ সাফল্য এসেছে। আগে আমরা ভালো  বীজ, সার, কীটনাশক চিনতাম না। বাজারে দোকানীরা যা দিতেন তাই ব্যবহার করতাম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এমফোরসি আমাদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ভালো বীজ, সার, কীটনাশক চিনিয়েছে। আগে না আসলেও এখন তাদের কারণে চরে কৃষি কর্তকর্তারা আসছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। উৎপাদন বৃদ্ধির এগুলোই কারণ। একই সাথে এমফোরসির লোকজনের মাধ্যমে চরে উৎপাদিত পণ্য বড় বড় কোম্পানির কাছে বিক্রির সুযোগ হয়েছে।"

'দ্য ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া এন্ড দ্য নিয়ার-ইস্ট' গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, চর জন্মের পর ৪ থেকে ৫ বছরের মাথায় ভাঙ্গনের শিকার না হলে সেখানে চাষাবাস ও বসবাসের যোগ্য হয়। ন্যাশনাল চর এলায়েন্স ২০১৭ সালের এক রিপোর্ট বলছে, দেশে ৩২ জেলায় ১০০ উপজেলার চরে ১ কোটি মানুষ বসবাস করেন। এটি মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। এর মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের চরে ১০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন।

প্রকল্প এলাকার চরে সাধারণত ১৫ ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। এগুলো হলো- মরিচ, ভুট্টা, বাদাম, সরিষা, মাসকলাই, ঢেঁড়শ, পাট, মিষ্টিকুমড়া ও বিভিন্ন জাতের শাকসবজি। এর মধ্যে লালমনিরহাটে সবচেয়ে বেশি উদপাদিত হয় ভুট্টা। জেলার হাতিবান্দা উপজেলার দক্ষিণ সিন্দুল্যা চরে বসবাস করেন রফিকুল ইসলাম। ৩০ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেন তিনি। এর মধ্যে অন্তত ১৬ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেন।

গত আট বছরের ব্যবধানে ভুট্টার উৎপাদন কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রশ্ন করতেই মৃদু হেসে রফিকুল বলেন, "কয়েক বছর আগে আরডিএতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ব্যাপক লাভ হয়েছে। চাষাবাদের পদ্ধতি, বীজ, বাজারজাতকণে সুফল এই অঞ্চলে আলোর দিশারী হয়ে এসেছে। এখন মেইনল্যান্ডের চেয়ে চরের জমিতেই বেশি ভুট্টা ফলে। আগের চেয়ে এখন চরে অন্তত দেড়গুণ ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।" 
আরডিএ বলছে, চর জীবিকায়ন প্রকল্পের কল্যাণে গত ৮ বছরের ব্যবধানে চরের গড় কৃষিজ উৎপাদন ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই তথ্যকে আরও শক্তিশালী করে ফুলছড়ি চরের বাসিন্দা মোকছেদ আলীর বক্তব্য। তিনি জানান, "আমাদের নিজস্ব বীজ দিয়ে ভুট্টা আবাদ করলে প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১২ মণ পাওয়া যেতো। এরপর অফিসাররা আমাদের জানালেন ভালো বীজে ভালো ফলন। পরে তাদের পরামর্শে ভালো বীজ রোপণ করলাম। এরপর ফলন ৩০ থেকে ৩৫ মণ পাওয়া গেলো। আগে মাটিতে ভুট্টা শুকানো হতো। এখন ত্রিপলে শুকানো হয়। এতে ভুট্টার গুণগতমান-রং ঠিক থাকে।"

তিনি আরও বলেন, "চরের মধ্যে আগে কোনো কৃষি কর্মকর্তা আসতেন না। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কৃষি কর্মকর্তা আসছেন। সময়মতো উপযোগী ওষুধ দেওয়া শুরু হলো ফসলে। সরেজমিনে পরামর্শ পাওয়া গেলো। আগে প্রতি বিঘায় ৪ থেকে ৫ মণ মরিচ পাওয়া যেতো। এখন ১৪ মণও উৎপাদন হয়। মরিচ বিক্রি করতে এখন হাটে যেতে হয় না। স্থানীয়ভাবে উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তারাই মরিচ কিনছে। বড় কোম্পানিগুলো ভুট্টা কিনছে চর থেকেই।"

ফুলছড়ির দেলুয়াবাড়ি চরের ৬ বিঘা জমি রয়েছে নাছিমা বেগম-দুলাল হোসেন দম্পতির। নাছিমা বলেন, "ভুট্টা, মরিচ, মিষ্টিকুমড়া বিক্রির জন্য মাথায় করে নদীর পশ্চিম পাড়ের (লোকালয়ে) বাজারে নিতে হতো। এখন চরের মধ্যেই অনেক ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছে। ভালো ফলনের পাশাপাশি পণ্য ভালো বলে চাহিদাও বেড়েছে। এনজিওদের পক্ষ থেকে এখন ঋণ দেওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি আসে। আগে গাইবান্ধা অফিসে গেলেও ঋণ দিত না।"

কয়েক বছর আগেও জমিতে সারের মতো ছিটিয়ে ভুট্টা চাষ করতেন ফুলছড়ি চরের মো. ইউনুস আলী। তখন প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১২ মণ ভুট্টা পাওয়া গেছে। এখন ১২ ইঞ্চি বাই ২২ ইঞ্চি দূরত্বে ভুট্টার গাছ রাখা হয়। চারাও মারা যায় না। এতে ফলন প্রায় দ্বিগুণের বেশি হচ্ছে। ইউনুস বলেন, "চরের ভুট্টার গুণগত মানও এখন খুব ভালো। এ কারণে ভুট্টা বিক্রি করতে এখন আর দালাল লাগে না।"

মোট ৬৫ একর চাষাবাদযোগ্য জমি রয়েছে প্রকল্প এলাকায়। এমফোরসির তথ্যমতে, প্রকল্প এলাকায় চরের ১ লাখ ১৬ হাজার ৪০৯ জন কৃষক রয়েছেন। ব্যবসায়ী রয়েছেন ৫৯৬ জন। এসব ব্যবসায়ীরা মিলে গত বছরে ৪ হাজার ৭৪ মিলিয়ন টাকার শস্য কেনাবেচা করেছেন। এর মধ্যে চরের শস্য রয়েছে ১ হাজার ৫৫৫ মিলিয়ন টাকার। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, মরিচ, বাদাম, সরিষা, আলুসহ বিভিন্ন রকমের শাকসবজি ও পাট।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, প্রকল্প এলাকার কৃষকদের জন্য ১৯টি ফসল সংরক্ষণ ও বিপণন কেন্দ্র করা হয়েছে। চরের পণ্য উৎপাদন, বিক্রির জন্য কৃষক ও কোম্পানির সাথে লিয়াজোঁ করতে ৩০৬ জন টিওএস (ট্রেডার আউট গ্রোয়ার স্কিম) সংযুক্ত করা হয়েছে। ২০২২ সালে প্রায় ৩০ হাজার ৩৫০ জন (৬৯% নারী) কৃষক টিওএসের মাধ্যমে ফসল ও গবাদিপশু উৎপাদন-বিক্রি করেছেন। টিওএসের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা বড় বড় কোম্পানির সাথে কৃষকদের যোগাযোগও করিয়ে দেন।

ফিড উৎপাদনে দেশের অন্যতম বড় কোম্পানির মধ্যে একটি আফতাব গ্রুপ। এই কোম্পানির সাথে চরের কৃষকদের এখন সরাসরি যোগাযোগ হয় কাঁচামাল সরবরাহের মাধ্যমে। ভুট্টা ফিড তৈরির কাঁচামাল। গত বছর এমফোরসি প্রচেষ্টায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি চরে এসেছিলেন আফতাব গ্রুপের পরিচালক (ক্রয়) কাজী সিব্বির আহমেদ। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, "আফতাব গ্রুপ ২০১৭ সাল থেকে প্রান্তিক চাষীদের কাছ থেকে সরাসরি ভুট্টা কিনছে। এ কারণে আমরা ভুট্টা আমদানি কমিয়েছি। চরে উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান আমদানি করা ভুট্টার চেয়ে অনেক ভালো। এমনকি মূল ভূখণ্ডের চেয়ে ভালো মানের ভুট্টা উৎপাদন করা হয়।"

তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে চর থেকে সরাসরি আফতাব গ্রুপ ৯০ হাজার টন ভুট্টা কিনেছে। ২০২০ সালে ১ লাখ টনের বেশি ভুট্টা কিনেছে। এতে কৃষকরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন। এটি এমফোরসির সফল যোগাযোগ তথা আমাদের দেশের ব্যাপক সাফল্য যে আমরা আমদানি কমাতে পারছি চরের ভুট্টার কল্যাণে। আমরা চাই মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো ভালো থাকুক।"

আফতাব গ্রুপ চরের ভুট্টা কেনার জন্য শুধুমাত্র জামালপুর এলাকাতেই ৩০টি বড় বড় গোডাউন ভাড়া নিয়েছে। এমফোরসি বলছে, গত বছর আফতাব গ্রুপ শুধুমাত্র গাইবান্ধা ও জামালপুর চর থেকে ৫০ হাজার টন ভুট্টা কেনার টার্গেট করেছিল। তবে টার্গেট পূরণ হয়নি। ভুট্টায় আর্দ্রতা বেশি ছিল। আফতাব ১২ শতাংশ আর্দ্রতা রয়েছে এমন ভুট্টা ক্রয় করে। কিন্তু এর মধ্যেও তারা তুলনামূলকভাবে বেশি আর্দ্রতাযুক্ত ভুট্টা কিনে তাদের গোডাউন এলাকায় শুকিয়েছে; কারণ চরের ভুট্টার গুণগত মান চমৎকার। চরে ভালো ভুট্টার উৎপাদিত হয় বলে নারিশ, প্যারাগন, এসিআই, সিপিসহ অনেক কোম্পানির চাহিদা বাড়ছে।

কাজী ফিড মিলে সরাসরি ভুট্টা সরবরাহ করেন গাইবান্ধার কামারজানি চরের কৃষক ও ব্যবসায়ী কমর উদ্দিন। অন্যান্য কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে কাজী ফিডকে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন ভুট্টা সরবরাহ করছেন তিনি।

চরের মাটির কারণে ফসলের গুণগতমান অন্ত্যন্ত ভালো হওয়ায় এর চাহিদাও বেশি বলে জানালেন লালমনিরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হামিদুর রহমান। এই কৃষিবিদ বলেন, মাটির উর্বরতা শক্তি, ভালো বীজ আর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে চরে এখন মূল ভূণ্ডের চেয়ে অনেক ভালো ফসল ফলে। এই কারণে চরে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা এখন অনেক। চরের মরিচেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানান তিনি।

২০১৮ সাল থেকে চরে উৎপাদিত মরিচ কিনছে স্বয়ার গ্রুপ। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে তাদের প্রসেসিং অঞ্চল হলেও তারা ৭০ শতাংশের বেশি মরিচ সংগ্রহ করেন গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে। বগুড়ায় অবস্থিত স্কয়ারের চিলি প্রসেসিং প্রজেক্টের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, "চলতি বছর চর থেকে আমরা ৩ হাজার ২০০ টন মরিচ সংগ্রহ করেছি। গত বছর ৪ হাজার টন সংগ্রহ করা হয়। চরের মরিচের গুণগতমান ভালো হওয়ার কারণে এর চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।"

আরডিএর যুগ্ম পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক ড. আব্দুল মজিদ প্রমাণিক বলেন, "চরে সব ধরনের সবজি, ধান, পাটসহ বিভিন্ন আবাদ হয়। তারা আগে সনাতনী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতেন। এখন কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও ভালো বীজ দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। নদীর বালুচরে এখন তিনটি ফসল ফলে। এমফোরসি প্রকল্পের পরে চরের কৃষিজ উৎপাদন গড়ে অন্তত ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।"

কৃষি উপকরণ সহজলভ্য

সনাতনী চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন কৃষিতে প্রযুক্তির চাহিদা বেড়েছে। এই কারণে চরের কৃষকদের উন্নতমানের কৃষি উপকরণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২২ সালে চরে ২০৯২ জন কৃষককে (যাদের মধ্যে ১১৮০ জন নারী) প্রযুক্তি ও উন্নত বীজের সুফল সম্পর্কে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। তাদের মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকার উন্নতমানের সবজি বীজ বিক্রি করা হয়েছে। একই সাথে চরাঞ্চলের প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ বিক্রি করা হয়েছে। গবেষণা বলছে, চরের ফসল বেশি উৎপাদনের সাথে ভালো বীজ ও প্রযুক্তিবান্ধব কৃষি অত্যন্ত জরুরি।

বর্তমান সময়ে কৃষি প্রযুক্তির চাহিদা বেড়েছে বিষয়টি নিশ্চিত করে ফুলছড়ি ইউনিয়নের কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী সোনাহার বাদশা বলেন, "যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বেশি ফসল ঘরে তুলতে কৃষকরা ভালো প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন। আগের চেয়ে প্রযুক্তি চাহিদা বেড়েছে বহুগুণে।"

কৃষি ঋণ

চরের অবকাঠামোগত (বাজার ব্যাবস্থা) উন্নয়নের ক্ষেত্রে মূলধন সংস্থানের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্তকরণের মধ্যস্থতার মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনমানের চিত্র পাল্টে গেছে। চরের কৃষিকে সমৃদ্ধ করতে ২০২২ সালে ৪ হাজার ৬৮২ জন কৃষককে ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। একই সাথে ৮৭৫ জন উদ্যোক্তাকে ১১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব টাকা কৃষকরা চাষাবাদ করেছেন। কৃষি প্রযুক্তি কিনে বিভিন্ন খাতে খরচ করেছেন। একই সাথে আরডিএ সহজ শর্তে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। তবে সুখবর হচ্ছে, চরের কৃষকরা শতভাগ ঋণ পরিশোধ করেন।

উদ্যোক্তা তৈরি

চরে ভালোমানের কৃষি পণ্য তৈরির মাধ্যমে ব্যাপক বাজার তৈরি হয়েছে। বড় বড় বিভিন্ন কোম্পানির সাথে কৃষক পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকেরাও লাভবান হচ্ছেন। এতে চরাঞ্চলে নতুন নতুন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের।

চর এলাকায় অন্তত ৪ হাজার উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকার। এর মধ্যে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ নার্সারি করেছেন। অনেকে আবার পশুপাখির কৃত্রিম প্রজনন সেবায় সাথে সংযুক্ত রয়েছেন। নারীদের মধ্যে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন।

চরের মধ্যে বিপ্লবের আরেক মাত্রা যোগ করেছে পশুপালনে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার মাধ্যম। আগে দেশি গরু পালন করতেন চরের কৃষকেরা। এখন কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিদেশী জাতের গরু লালনপালন করছেন। চরের উদ্যোক্তা সুলতান হোসেন এখন ফুলছড়ি ঘাট এলাকা থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৩০০ ডোজ শাহীওয়ালসহ বিভিন্ন জাতের বিদেশী সিমেন বিক্রি করছেন।

সুলতান বলেন, "কৃষিক্ষেত্রের মতোই চরের মানুষ এখন গরু-মহিষ পালনে সচেতন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পাওয়া পর চরের মানুষের মধ্যে বিদেশী জাতের গরু-মহিষ পালনের প্রবণতা বেড়েছে। আগে মনুষ গরু-মহিষের প্রজনন নিয়ে চরের মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এখন আগ্রহের দিক বিবেচনা করে আমি কয়েকজন সহযোগী রেখেছি।"