খোরশেদ আলম, বগুড়া
সরকারি বিশেষ বরাদ্দের টাকা দেওয়ার কথা ছিল গরীব-অসহায়দের। অথচ দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের স্বজনদের। একই পরিবারের একাধিক সদস্য পেয়েছেন সহায়তা। তারাও আবার সচ্ছল। এদের মধ্যে কারও ফ্লাট বাড়ি রয়েছে। কারও রয়েছে গাড়ি। কেউ পুরো একটা মার্কেটের মালিক! অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারের ক্ষমতার জোরেই এসব অনিয়ম হয়েছে।
ঘটনা বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের। সরকারি অনুদান ও ভাতা অসহায় বাদে স্বজনদের নামে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ও মেম্বার সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে।
তবে চেয়ারম্যানের দাবি, স্বজনেরা গরীব বলেই সরকারি বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর মেম্বার দাবি করেছেন, তিনি প্রতিহিংসার শিকার।
স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে উপজেলা চেয়ারম্যানের ত্রাণ কমিটির প্রতিনিধি ওয়াজেদ হোসেন অভিযোগও দিয়েছেন। এর মধ্যেই জয়যুগান্তরের অনুসন্ধানে ত্রাণের টাকা নিয়ে অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির বিষয়টি উঠে এসেছ।
করোনাভাইরাসের কারণে বিপদে পড়া পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ টাকা (প্রতিজনকে ২৫০০ টাকা) দেওয়া হয়। কিন্তু মহিষাবানে চেয়ারম্যান-মেম্বারের তাদের পছন্দের লোকজনকে টাকা দিয়েছেন। এমনটি সরকারি একাধিক ভাতা পাওয়া পরিবারকেও দেওয়া হয়েছে।
অথচ খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নীতিমালা ২০১৭ মতে, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকভুক্ত করা যাবে না। ভিজিডি কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্তদের তালিকায় নেওয়া বারণ করা হয়েছে।
অনুসন্ধান পর্ব
চেয়ারম্যানের আপন ভগ্নিপতি মহিষাবানের মো. জিন্নাহ প্রমাণিক। ত্রাণের নগদ টাকায় তার নাম রয়েছে ২১৭ নম্বর তালিকায়। তিনিই আবার রেশন কার্ডেরও সুবিধাভোগী। কার্ড নম্বর ১৩৮৪। বয়স্ক ভাতার কার্ডও রয়েছে তার নামে। জিন্নাহর ছেলে মো. আল আমীনও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেওয়া নগদ টাকা পেয়েছেন ক্ষমতাবান মামা চেয়ারম্যানের জোরে।
আমিনুলের আপন ছোট বোন মোছা. লুতফুন্নেছা জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে বয়স্ক নিচ্ছেন। তার ছেলে মো. উজ্জলকে নগদ ত্রাণের টাকা দেওয়া হচ্ছে। ত্রাণের টাকায় তার নাম ১৯৭ নম্বর রয়েছে। তার আপন ভাই মো. রফিকুল ইসলামের নাম রয়েছে ১৯৮ নম্বরে। মামার ক্ষমতাকে বেশ কাজে লাগিয়ে ১৯৯ নম্বর তালিকায় নাম তুলে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নগদ টাকা পেয়েছেন লুতফুন্নেছার আরেক ছেলে মো. রুবেল প্রামাণিকও।
চেয়ারম্যানের অন্য এক বোনের স্বামী নজমল হোসেন। তিনিও জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতা নিয়েছেন। বয়স্ক ভাতা হিসাব নম্বর ৮৮০। নজমল ত্রাণের নগদ টাকাও পেয়েছেন। তালিকায় তার নাম ২৩১ নম্বরে রয়েছে। তার ছেলে গোলাম রাব্বানী ত্রাণের টাকা পান। তালিকার তার নাম ২২৮ নম্বরে। নজমলের আরেক ছেলে মো. মহব্বত আলী ত্রাণের টাকা পেয়েছেন ১৬৫ নম্বরে।
রেশন কার্ডে থাকা ১৩৪৮ নম্বর ব্যক্তি মোছা. শাবানা বেওয়া। তিনি বিধবা ভাতা পাচ্ছেন ১২৯১/১ নম্বর কার্ড অনুসারে। শাবানাও চেয়ারম্যানের আপন বোন। তার মেয়ে জুই খাতুন ভিজিডি কার্ড রয়েছে। কার্ড নম্বর ৭৯। জুইয়ের মামা চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে পেয়েছেন ত্রাণের টাকাও। নগদ ত্রাণের টাকায় জুই ১১২ নম্বরে রয়েছেন।
আমিনুল ইসলামের ফুফাতো বোনের নাম ওমিলা খাতুন। ত্রাণের কার্ড নম্বর ১৫৭। তার রেশন কার্ডও রয়েছে। নম্বর ৪৫৮। তবুও চেয়ারম্যান কোটায় তিনি এমন সুযোগ পেয়েছেন।
চেয়ারম্যানের আরেক ফুফাতো ভাইয়ের মেয়ের নাম শাহানা খাতুন। নগদ ত্রাণের টাকা পেয়েছেন তিনি। তিনি মাতৃত্বকালীন ভাতাও পান তালিকার ১১ নম্বর অনুসারে। তার আপন বোন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নগদ ত্রাণের টাকা পেয়েছেন ১৪৮ নম্বর অনুসারে।
চেয়ারম্যানের মামাতো ভাই মহিষাবানের মো. নুরুল ইসলাম নগদ টাকা পেয়েছেন ২১৬ নম্বর অনুসারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তালিকায় তার নাম বয়স্ক ভাতায় রয়েছে। আমিনুল ইসলামের বাড়িতে কাছের লোক হিসেবে পরিচিত কাজের লোকের নাম মোতাহার। তিনি ত্রাণের নগদ টাকা পেয়েছেন। তার বোন মোছা. পারভীন আক্তারেরও ভিজিডি কার্ড রয়েছে। তার পিতা বয়স্ক ভাতা পান বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, ‘তার আত্মীয়-স্বজনেরা অত্যন্ত গরীব। তারা সরকারি এসব সহায়তার পাওয়া যোগ্য। এই কারণে তিনি তাদের এসব সহায়তার আওতায় নিয়ে এসেছেন।’
চেয়ারম্যানের সাথে থাকেন মিলন নামের এক ব্যক্তি। এলাকার লোকজন তাকে চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে জানেন। তার বিল্ডিং বাড়ি রয়েছে মহিষাবানের কানিয়াপাড়া এলাকায়। রয়েছে গাড়িও মোটরসাইকেল। অথচ চেয়ারম্যানের আর্শিবাদে তিনি পেয়েছেন নগদ টাকা। তালিকায় ২৩৬ নম্বরে তার নাম রয়েছে। মিলনের স্ত্রী মাহজাবিনেরও রয়েছে ভিডিজি কার্ড। নম্বর ১৯৬। মিলনের ছোট বোন শাবানা বেগমের রয়েছে ভিজিডি (১৪০) কার্ড। একই সঙ্গে তিনি বিধবা ভাতাও (২২) পান।
মিলনের ভাগ্নি শিখা খাতুনের বিয়ে হয়েছে বগুড়া সদরে। অথচ তিনি গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়ন থেকে ভিজিডি কার্ডের সুবিধা নিচ্ছেন। তার কার্ড নম্বর ১৪১। তিনি মাতৃত্বকালীন ভাতাও পান। ভাতা নম্বর ৩৯।
মহিষাবান ইউনিয়নের প্রভাবশালী সদস্য সুলতান। তার বাবার বয়স্ক ভাতার কার্ড করেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে। তার স্ত্রী মোছা. রত্না মাতৃত্বকালীন ভাতা পান। তার ভাই শহিদুল ইসলাম নগদ টাকা পেয়েছেন। তালিকায় তার নাম রয়েছে ১৮৭ নম্বরে। সুলতানের মামা মুনো প্রামাণিত এনআইডি জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। তার স্ত্রী ববি বেগম রেশন কার্ড রয়েছে।
সুলতানের মামাতো বোন রানীরপাড়ার মঞ্জুরি বেগম ভিডিজি সহায়তা পান। তার নামেই আবার রেশন কার্ড রয়েছে। কার্ড নম্বর ৪৯৫।
সুলতান মেম্বারের আপন খালা নামেও ভিজিডি কার্ড (৬৬) রয়েছে। মেম্বারের চাচাতো বোন রানীরপাড়ার আফরোজা বেগমের ভিজিডি কার্ড (৮৯) রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাতৃত্বকালীন ভাতা (২১) পান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আফরোজার স্বামী মুঞ্জু মিয়া বিদেশ থেকে এসে ফ্লাট বাড়ি করেছেন। তাদের মোটরসাইকেলও রয়েছে।
সুলতান মেম্বারের মামা লেদা প্রামাণিক নগদ টাকা (১০৭) পেয়েছেন। তার নামে রেশন কার্ড রয়েছে। কার্ড নম্বর ৫৩৫।
প্রভাবশালী ইউপি সদস্য সুলতানের আপন খালাতো বোন মোছা. রুপশা বেগমের স্বামী মাহমুদুল হাসানের ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর এলাকায় বড় মার্কেট রয়েছে। ওই মার্কেটে তার কাপড়ের দোকান রয়েছে। অথচ তাকে ভিজিডি কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। তার কার্ড নম্বর ৯৫।
রুপশার স্বামী মাহমুদুল হাসান মোবাইলে বলেন, ‘গোলাবাড়ী বন্দরে তার ১০ টি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। তিনি নিজেই একটি দোকান চালান। দোকানের আয় দিয়েই তার সংসার চলে।’
তবে জানতে চাইলে সুলতান মাহমুদ মোবাইলে জয়যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। অভিযোগকারীর সাথে চেয়ারম্যানের শত্রুতা রয়েছে। চেয়ারম্যানের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। এ কারণে আমার নামেও অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’
মহিষাবানের বুলু প্রামাণিক বয়স্ক ভাতা পান। একই সঙ্গে তিনি পেয়েছেন নগদ টাকাও। নগদ টাকার তালিকায় তিনি ২৫৩ নম্বরে রয়েছেন।
মহিষাবানের ওবায়দুল সরকার পেয়েছেন নগদ টাকা। তার স্ত্রী জেমি খাতুন পান ভিজিডির চাল। কার্ড নম্বর ১৯৮। রানীরপাড়ার আমাদুল মন্ডল নগদ টাকা পেয়েছেন ১৫৫ নম্বর অনুসারে। তার প্রথম স্ত্রী হেলেনা বেগমের রেশন কার্ড নম্বর ৫১৩ ও দ্বিতীয় স্ত্রী মেঘনা বেগমের রেশন কার্ড নম্বর ৫১৫।
ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রে কাজ করার সুবাদে প্রায় সব রকমের সুবিধা আদায় করে নেন সাথী বেগম। তার নামে রেশন কার্ড, মাতৃত্বকালীন কার্ড, ভিজিডি কার্ড রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নগদ ত্রাণের টাকাও পেয়েছেন। এতোগুলো সরকারি সুবিধা এক সাথে নেওয়ার কথা অবলীলায় স্বীকারও করেছেন সাথী। তিনি বলেন, ‘সরকার তাদের বেতন দেয় না বলেই তিনি সব কার্ডের সুবিধা নেন।’ এভাবে তাকে একাধিক সরকারি সুবিধা দেওয়ার কথা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামও স্বীকার করেছেন।
কেবল তাই নয়, চেয়ারম্যান নিজস্ব ক্ষমতাবলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অন্তিম চন্দ্র মজুমদারকেও বয়স্ক ভাতার আওতায় নিয়ে এসেছেন।
এই বিষয়ে চেয়ারম্যানের দাবি, ‘সরকারির সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি এসব কার্ড পায় কিনা এই আইন তার জানা নেই।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রওনক জাহান বলেন, ‘মহিষাবানের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’