Joy Jugantor | online newspaper

বিশ্বব্যাপী সিইওরা এত বেশি বেতন কেন পান?

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২৬ মে ২০২২

আপডেট: ১১:৩৮, ২৬ মে ২০২২

বিশ্বব্যাপী সিইওরা এত বেশি বেতন কেন পান?

সংগৃহীত ছবি

ব্লুমবার্গের হিসেবমতে, ২০২০ সালে বিশ্বের সর্বাধিক আয় করা তিন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) ছিলেন এলন মাস্ক, মাইক পাইকোজ, এবং ট্রেভর বেজডেক। তাদের আয় ছিল যথাক্রমে ৬.৬৬ বিলিয়ন, ৫৬৮.৪ মিলিয়ন, এবং ৪৯৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত বিশ্বব্যাপী সিইওদের বেতন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পৃথিবীজুড়ে সিইওদের এহেন ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী বেতনের কারণ কী?

'ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জ ইনডেক্স ১০০' বা সংক্ষেপে এফটিএসই ১০০। উচ্চারণের আয়াশের জন্য মানুষের মুখে মুখে এটি ফুটসি নামেও পরিচিত। বাজারে মূলধনের প্রাচুর্যের উপর ভিত্তি করে লন্ডনের শেয়ার মার্কেটে তালিকাবদ্ধ প্রথম ১০০টি প্রতিষ্ঠানকে একসাথে ডাকা হয় এফটিএসই ১০০ বা ফুটসি নামে। লন্ডনভিত্তিক স্বতন্ত্র থিংক ট্যাংক হাই পে-র গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ফুটসি সিইওদের গড়পড়তা বার্ষিক আয় হলো ৪.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

৪.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেতন ঠিক কতটা বেশি সেটা বোঝার জন্য একটা তুলনা করা যেতে পারে। এই সিইওদের বেতন একই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত পূর্ণকালীন কর্মীদের তুলনায় ১১৫ গুণ বেশি। ফুটসিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে একদম ওপরে অবস্থান করছে অনলাইন সুপারমার্কেট ওকাডো। প্রতিষ্ঠানটির সিইও টিম স্টেইন ২০১৯ সালে বেতন পান ৫৮.৭ মিলিয়ন পাউন্ড যা ওকাডোর অন্য সকল কর্মকর্তার গড় আয়ের (২২,৫০০ পাউন্ড) ২,৬০৫ গুণ বেশি। হাই পে-র গবেষণামতে ওকাডোতেই কর্মকর্তা বনাম সিইওর বেতনে সর্বোচ্চ পার্থক্য বিরাজমান।


২০২০ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ বেতনধারী ১০ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা; Image Source: bloomberg.com
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইকোনোমিক পলিসি ইন্সটিউটের গবেষণানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক মুনাফার ৩৫০টি প্রতিষ্ঠানের সিইওদের ২০১৯ সালে গড় বেতন ছিল ২১.৩ মিলিয়ন ডলার। উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্যান্য সকল কর্মকর্তা এবং সিইওর বেতনের অনুপাত ছিল ১:৩২০।

বর্তমানে পৃথিবীর সেরা সেরা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিইওদের এত বেতনের যৌক্তিকতা নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। সিইওদের ভূমিকার তুলনায় তাদের বেতন কি সত্যিই যুক্তিযুক্ত? সিইওদের তুলনায় অন্যান্য কর্মচারীর বেতন তাহলে এত কম হবে কেন? জেনে নেওয়া যাক এসব বিষয়ে গবেষণা কী বলছে?


ওকাডোর সিইও স্টেইনারের বেতন তার প্রতিষ্ঠানের অন্যদের তুলনায় ২,৬০৫ গুণ বেশি; Image Source: theguardian.com
পশ্চিমা বিশ্বে সিইওদের এত অত্যধিক বেতনের কারণ হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রিগ্যান এবং যুক্তরাজ্যের থ্যাচার প্রশাসনের রাজনৈতিক দর্শনকে। ১৯৮০'র দশকে এই দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে মুক্তবাজার অর্থনীতি, সরকারি খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণ, লাগামহীন পুঁজি ব্যবস্থা তুমুল জনপ্রিয় হয়। শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যপারে তাদের প্রশাসনের চিন্তাভাবনা এতটাই কম ছিল যে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে শ্রমিকদের পক্ষ হয়ে কথা বলার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে লোপ পায়।


পৃথিবী জুড়ে সাধারণ কর্মীদের অসন্তোষ ক্রমেই বেড়ে চলেছে; Image Source: bbc.com ©️ Alamy
লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, জব ইভ্যালুয়েশন একটি সম্ভাব্য কারণ। জব ইভ্যালুয়েশন বলতে বোঝানো হয় সেসব মাপকাঠি যেসবের ভিত্তিতে একটি প্রতিষ্ঠানের জনসম্পদের কাজকে পরিমাপ করা হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে জব ইভ্যালুয়েশনের চলমান ধারণাটি অতীতের প্রচলিত ধারণা থেকে বেশ খানিকটা সরে গেছে। অতীতে একজন সিইওকেও অন্য আর দশজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ন্যায় প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি অন্যদের চেয়ে বেশি বেতনভোগী হলেও সেটি ছিল তার ভূমিকার কারণে যেটি তার তুলনামূলক অধিক আয়কে একধরনের ন্যায্যতা প্রদান করত। অন্যদিকে বর্তমানে একটি অলিখিত নিয়মানুযায়ী উচ্চ বেতনভোগী সিইওদের অনেকটা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মী সম্প্রদায়ের বাইরের কেউ বলে গণ্য করা হয়। এতে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সিইওরা অন্য আর দশজন সাধারণ কর্মীর তুলনায় সীমা ছাড়ানো বেতন পাবেন- এটি প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। ২০০০ সাল থেকে ফুটসি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ কর্মকর্তাদের বেতন ফি বছর বেড়েছে ৩% হারে, যদিও সিইওদের বেতন বেড়েছে ফি বছরে ১০% হারে। অসামঞ্জস্যতা টের পাওয়া যাচ্ছে?


বাজারে বর্তমানে প্রচলিত যুক্তিটি হচ্ছে যে, সিইওরা হচ্ছেন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণভোমরা। মালিকপক্ষ এবং সিইওরা যৌথভাবে বিশ্বাস করেন যে প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধনের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছেন সিইও। তারা এটা ভুলে যান অথবা হয়তো সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কেই এড়িয়ে যান যে একটি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভর করে দলগত প্রচেষ্টার উপর। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, সিইও যদি বিচক্ষণ হন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে পারেন, কর্মচারীদের উৎসাহ প্রদান করতে পারেন, তাহলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রভূত উন্নয়ন দেখা সম্ভব হয়। তবে পাশাপাশি এটাও মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চেতনার বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠানের পুরো জনসম্পদের মাধ্যমেই অর্জিত হয়।

সিইওদের এত অত্যধিক বেতন কি সত্যিই ন্যায্য কি না এই প্রশ্নের উত্তরে দুটি পক্ষ পাওয়া যায়। প্রথমোক্ত দলের মাঝে পড়বেন যারা নিজেদেরকে নিওলিবারেল দর্শনের অনুসারী বলে দাবী করেন এবং এদের সারথি হিসেবে মুক্তবাজার পুঁজিবাদে যারা অগাধ আস্থা পোষণ করেন। এদের সকলের বিস্তারিত যুক্তিকে এক বাক্যে বলতে হলে- সিইওরা হচ্ছেন দুর্লভ প্রতিভা। এই দলের মতে, সিইওদের এত অত্যধিক বেতন সম্পূর্ণভাবে সঠিক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এত অত্যধিক বেতন দিয়ে তাদের রাখতে চায় তার অর্থ এই যে প্রকৃতপক্ষে চলমান বাজার অর্থের এই অঙ্ককে স্বাভাবিক ভাবে। পাশাপাশি তারা বলেন, সিইওরা এত প্রভূত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, তাদের চিন্তাভাবনার ধরন এত সুস্পষ্ট, কর্মীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য জাগাতে তারা এতটা পারদর্শী, একাধিক বিষয়ে তাদের উল্লেখযোগ্য দক্ষতা ইত্যাদি বিষয় তাদের এত মোটা অঙ্কের বেতন পাওয়ার যোগ্য দাবীদার করে তুলেছে।

অন্যদিকে যারা সিইওদের বেতনকে মাত্রাতিরিক্ত বলছেন তারা প্রশ্ন তুলছেন আয়ের বৈষম্যকে ঘিরে। তাদের মতে, অ্যামাজনের জেফ বেজোস, অ্যাপলের স্টিভ জবস, টেসলা এবং স্পেস এক্স-এর এলন মাস্ক তারা সত্যিই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ব্যবসার দুনিয়ায় তারা বৈপ্লবিক কিছু করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মতো গুটিকয়েক ব্যতিক্রমকে হিসেবের বাইরে রাখলে বাদবাকি সিইওরা তো অসামান্য কিছু করে ফেলছেন না। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পোস্টকে তারা স্রেফ একটি ব্যবস্থাপকের পদ হিসেবেই বিচার করে থাকেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা প্রশ্ন রাখেন, একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বকে বলা যেতে পারে নেতৃত্ব প্রদান করা। অর্থাৎ, একজন সিইও পুরো দলকে একটি একক সত্ত্বা হিসেবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবেন। এই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিছু করতে হচ্ছে না যে তাদের এত বেতন পেতে হবে? বিশেষত, যখন প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মীদের সম্মিলিত বেতনের চেয়েও তিনি এতগুণ বেশি বেতন পান।

সিইওদের অত্যধিক বেতন মূলত সমস্যা না। মুশকিলটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের অন্যান্যদের চেয়ে তিনি তুলনাহীন বেতন ভোগ করছেন, যেখানে প্রতিষ্ঠান সন্দেহাতীতভাবে এগিয়ে যায় সবার সম্মিলিত উদ্যোগে। সম্প্রতি করোনার প্রকোপে দেখা গেছে যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে এতটাই কম বেতন পান যে হুট করে তাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা ব্যায়ভার বহন করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকলে আক্ষরিক অর্থেই সমান বেতন পাবেন এটা ভাবা বোকামি। নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হবে অন্তত এটুকু নিশ্চিত করা যে কর্মক্ষেত্রে বেতন বৈষম্য এতটাও মাথাচাড়া না দেয় যাতে একজন সুখের স্বর্গে থাকে আর অন্যরা মৌলিক সুবিধাটুকু থেকেও বঞ্চিত হন।