দেশের পুরোনো বিমানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, আসছে নতুন
দেশের পুরাতন বিমানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় যান্ত্রিক ত্রুটি, ফ্লাইট বিলম্ব ও যাত্রী ভোগান্তি কমাতে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বহরে ২৫টি নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এগুলো সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি এবং ধাপে ধাপে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলো দেশে এসে পৌঁছাবে। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এ ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনুমোদন দিয়েছে।
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বিমানের বহরের আধুনিকীকরণের ওপর জোর দিচ্ছেন। পুরোনো বিমানগুলো ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে নতুন, জ্বালানি-সাশ্রয়ী এবং যাত্রীবান্ধব বিমান যুক্ত করা হবে। এতে সেবার মান ও সময়ানুবর্তিতা বাড়বে। তিনি জানান, প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম দফার কিছু উড়োজাহাজ ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে পৌঁছাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমানের বহরে থাকা ১৯টি উড়োজাহাজের মধ্যে বেশির ভাগই পুরোনো। যার মধ্যে কিছুসংখ্যক উড়োজাহাজে কয়েক বছর ধরে যান্ত্রিক ত্রুটি বেড়েছে। প্রকৌশল বিভাগ থেকে রক্ষণাবেক্ষণের ছাড়পত্র নিয়ে কিছু বিমান ওড়ার অনুমতি পেলেও পাইলটসহ কর্মকর্তাদের আতঙ্ক কাটছে না। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, গত প্রায় এক মাসে অভ্যন্তীণ ও বিদেশি রুটে অন্তত ১০টি উড়োজাহাজে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। গত এপ্রিলে বোয়িং কোম্পানির একটি উড়োজাহাজের যাত্রা বাতিল হওয়ার পর গত মে আর জুনে ঠিকঠাকই ছিল সবকিছু। তবে জুলাই মাসে হঠাত্ করে একের পর এক ত্রুটি ধরা পড়তে থাকে। মাত্র ১৫ দিনেই (১৬-৩০ জুলাই) চারটি যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে ১৬ জুলাই রাতে চাকায় ত্রুটি দেখা দেওয়ায় দুবাই-চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারকে দুবাই বিমানবন্দরে গ্রাউন্ডেড করা হয়। এরপর ২৪ জুলাই দুবাই থেকে চট্টগ্রামে এসে ল্যান্ডিং গিয়ারের ত্রুটির মুখে পড়ে আরেকটি ড্রিম লাইনার। চার দিন পর ২৮ জুলাই ওড়ার পর কেবিন প্রেশারে ত্রুটির সংকেত পেয়ে ঢাকায় ফেরে দাম্মামগামী বোয়িং ৭৭৭-ইআর। দুই দিন পর ৩০ জুলাই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে শারজাহ বিমানবন্দরে ৬ ঘণ্টা আটকে থাকে বোয়িং ৭৩৭। সপ্তাহ খানেক ঠিকঠাক থাকলেও হঠাত্ একের পর এক ত্রুটি শনাক্ত হতে থাকে বিমানে। প্রায় পরপর ছয় দিনে ছয়টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৬ আগস্ট ইঞ্জিনে কম্পনের কারণে ব্যাংককগামী বোয়িং ৭৩৭ ফিরে আসে ঢাকায়। পরদিন ৭ আগস্ট টয়লেট বিকল হয়ে ঢাকায় ফেরে আবুধাবিগামী বোয়িং। দুই দিন পর ৯ আগস্ট সিংগাপুর থেকে ফেরার পথে সমস্যায় পড়ে বোয়িং-এর আরেকটি উড়োজাহাজ। পরদিন ১০ আগস্ট রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দরে ডানার ফ্ল্যাপ ত্রুটির কারণে ‘গ্রাউন্ডেড’ হয় বোয়িং ড্রিম লাইনার।
পরদিন ১১ আগস্ট কেবিনের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজকে ফিরতে হয় ঢাকায়। পরদিন ১২ আগস্ট যাত্রা বাতিল হয় বোয়িং ৭৮৭ ড্রিম লাইনারের। এসব ত্রুটি শনাক্ত হওয়ার পর বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বিমানগুলো নিরাপদে ফিরে অবতরণ করলেও যাত্রীসেবা ও রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার অভিযোগ ওঠে।প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচলকারী বিমানযাত্রী আরজুমান্দ হক ইত্তেফাককে বলেন, প্রাণ হাতে করে তো আর বিমানে যাতায়াত করা যাবে না। বিমানে একদিকে ঘন ঘন ত্রুটি ধরা পড়ছে, আরেক দিকে যাত্রীসেবার মান খুবই কম। এখন দেখছি, কষ্ট হলেও বিমান ছেড়ে বাস-ট্রেনেই যাতায়াত করতে হবে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে থাকা বেশির ভাগ উড়োজাহাজই পুরোনো হয়ে গেছে। কোনো কোনোটি দেড় থেকে দুই যুগ ধরে বিরামহীনভাবে যাত্রীসেবা দিয়ে আসছে। অনেক উড়োজাহাজে ছোটখাট সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব ত্রুটি শনাক্ত হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ টি এম নজরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ছোটখাট প্রযুক্তিগত ত্রুটি বিমানে হতেই পারে। তবে সেগুলো ফ্রিকোয়েন্সিতে ঘটেছে তা অবশ্যই শঙ্কা জাগানিয়া। যেসব লগ এন্ট্রি হচ্ছে, সেগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, অনুসন্ধান হওয়া দরকার।
জানতে চাইলে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও অ্যাভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, বহরের বেশির ভাগ উড়োজাহাজ অনেক পুরোনো হওয়ায় সমস্যা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ত্রুটি দেখা দেওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তদারকিও বাড়িয়ে দিতে হবে।এসব বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ বি এম রওশন কবীর ইত্তেফাককে বলেন, কিছুদিন ধরে ফ্লাইটে যেসব ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে তার কারণ অনুসন্ধান ও সংকট নিরসনে একজন সিনিয়র ক্যাপ্টিনের নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাণিজ্যসচিব যে বিমান কেনার কথা বলেছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে রওশন কবীর বলেন, এ বিষয়ে আমাদের জানা নেই।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত লাল-সবুজের পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ১৯৯৬ অবধি দেশে উড়োজাহাজ খাতের একক সংস্থা হিসেবে ব্যবসা চালিয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশের সঙ্গে বিমানসেবা চুক্তি থাকলেও বর্তমানে ১৬টি দেশে বিমানের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। বর্তমানে সংস্থাটির বহরে থাকা ১৯টি বিমানের মধ্যে ১৪টিই যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে কেনা।