লোটাস কামাল, ইমরান, নিজাম হাজারী ও বেনজীরসহ ১০১ এজেন্সিকে সিআইডির অব্যাহতি
২৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ থেকে সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল, তার স্ত্রী কাশ্মিরী কামাল, মেয়ে নাফিসা কামাল, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুস সালেহীনসহ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি বড় সিন্ডিকেটকে অব্যাহতি দিয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ পর্যালোচনা বা প্রত্যাহারের জন্য মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে অনুরোধ করার তিন মাস পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত ১৫ জুলাই ঢাকার মানব পাচারবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মানব পাচারসংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক (সিরিয়াস ক্রাইম) মো. রাসেল বলেছেন যে, তদন্তে অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে বাদী আলতাব খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে, বাদী আলতাব খান চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিয়েছেন। নারাজি পিটিশনে বাদীর আর্জিতে বলা হয়, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক অবশ্যই অভিযুক্তদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাই এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এর আগে ২৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব দাতুক আজমান বিন মোহাম্মদ ইউসুফ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়াকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগসংক্রান্ত মামলাগুলো পর্যালোচনা বা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন।
বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকের অধীনে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য গিয়েছিলেন। তাদের সব নিয়োগের নথিপত্র ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নামে একটি ওয়েবভিত্তিক সিস্টেম দ্বারা পরিচালনা করা হয়। সমঝোতা স্মারক অনুসারে, একজন শ্রমিককে মালয়েশিয়া পাঠাতে খরচ ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ মার্চ জাতিসংঘের চার জন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক শোষণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন, 'প্রতিটি অভিবাসী সাড়ে ৪ হাজার ডলার থেকে ৬ হাজার ডলার (৫-৬ লাখ টাকা) খরচ করেছেন। পুরো প্রক্রিয়াটি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ঘুষ দিয়ে শুরু হয় ভুয়া নিয়োগকর্তাদের জন্য ভুয়া কোটা। পরবর্তীকালে নিয়োগ অনুমোদনের সুবিধার্থে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং বাংলাদেশি সিন্ডিকেট এজেন্টদের কাছে ঘুষ পৌঁছে দেওয়া হতো।'
এর জবাবে, গত বছরের ২৯ মে জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের মিশন বলেছিল যে, ঢাকা তার ১ হাজার ৫২০টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিতে চায়, কিন্তু কুয়ালালামপুর মাত্র ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে নির্বাচন করেছে।মার্চ মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন সময়ে মানব পাচারের মাধ্যমে ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং তার পরিবার, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও বেনজির আহমেদসহ ১২ জন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে ১২টি পৃথক মামলা দায়ের করে।
এদিকে, রিক্রুটিং এজেন্সি আফিয়া ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী আলতাব খান গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর পল্টন মডেল থানায় সাবেক প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সচিব আহমেদ মুনিরুস সালেহীন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তার স্ত্রী কাশ্মীরি কামাল, মেয়ে নাফিসা কামাল, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, সাবেক এমপি লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও বেনজির আহমেদ সহ ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে একটি মানব পাচার মামলা দায়ের করেন। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ২৪ হাজার কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।মামলার বাদী আলতাব খান বলেন, মালয়েশিয়ায় অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে শোষিত, আটক, বেকার করা হয়েছিল এবং তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিল-এগুলো সবই মানব পাচারের লক্ষণ। আফিয়া ওভারসিজসহ বাংলাদেশের অনেক রিক্রুটিং এজেন্সিও বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়কারী সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. রাসেল বলেন, মামলার বাদী সরাসরি ভুক্তভোগী নন। কারণ এই মামলায় ভিকটিম হলেন শ্রমিক। মালয়েশিয়ায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার শ্রমিক যারা গিয়েছিলেন, তাদের কেউই মামলার বাদীকে টাকা দেননি। ভিকটিমরা ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে না গিয়ে অন্তত ৩ হাজার এজেন্সির কাছে টাকা দিয়েছিলেন। তাদের কেউ ৪ লাখ টাকা, কেউ সাড়ে ৪ লাখ টাকা, আবার কেউ-বা ৫ লাখ টাকা দিয়ে থাকলেও তারা প্রত্যেকে ৭৮ হাজার টাকা প্রদানের নথিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। যদি তারা বেশি অর্থ প্রদান করেন, তাহলে তাদের নিজেদেরকেই অভিযোগ দায়ের করতে হবে। এখন পর্যন্ত এক জন ভুক্তভোগীও অভিযোগ করেননি। মামলায় যথাযথ প্রমাণের অভাব রয়েছে।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী আলতাব খান বলেন, ইন্টারপোলের জাতীয় কেন্দ্রীয় ব্যুরো গত বছরের ২৪ অক্টোবর মালয়েশিয়ার পুলিশের কাছে মানব পাচার এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে দুই অভিযুক্ত মাস্টারমাইন্ড-বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান নাগরিক মো. আমিনুল ইসলাম (আমিন নূর) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের প্রাক্তন মহাসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমিন স্বপনকে গ্রেফতার করার জন্য সহায়তা চেয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে অর্থ ও মানব পাচারের আসল চিত্র প্রকাশ পাবে।