বগুড়ার রেশম বোর্ডের সামনে সম্প্রতি তোলা। ছবি :জয়যুগান্তর
বগুড়ার বনানী রেশম বোর্ডের সামনের পৌরসভার বর্জ্যরে ট্রান্সফার স্টেশন। শহরের একটি অংশের বর্জ্য প্রতিদিন জড়ো করা হয় এখানে। এই বর্জ্যরে স্তুপের মাঝে আনমনে খুটছেন ২২ বছরের তরুণী সুমি আক্তার। খেয়াল করতেই দেখা যায় প্লাস্টিকের বোতল, কাগজ, পলিথিন সংগ্রহ করছেন তিনি।
দুর্গন্ধের কারণে যার পাশ দিয়ে চলা দুর্দায়, সেখান থেকেই নিজের জীবিকা খুঁজে নিয়েছেন এই তরুণী। শুধু সুমিই নয়, এমন পেশার সঙ্গে জড়িত বগুড়ার কয়েকশ মানুষ। তবে শঙ্কার কথা হলো এসব পচা-গলা, বিষাক্ত বর্জ্য থেকে জীবিকা চালালেও নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। ব্যবহার করেন না কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা।
ফলে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা দীর্ঘমেয়াদে নানা মরণঘাতী সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি তাদের মাধ্যমে আশেপাশের মানুষরা পড়তে পারেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
সুরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে টিটি ইনজেকশন, স্বাস্থ্য শিক্ষা, হাই বুট জুতা, হ্যান্ড গ্লোভস নিশ্চিত রেখে কাজ করলে অসুস্থতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
রেশম বোর্ডের সামনে কাজের এক ফাঁকে সুমী আক্তারের সঙ্গে আলাপ হয়। সুমীর বিয়ে হয়েছে একজন অটোরিকশা চালকের সাথে। তিনি জানান বাবা, মা, ভাই, বোন আর স্বামী সন্তান নিয়ে শহরের রেলস্টেশনে থাকেন। জীবিকার তাগিদে ও সংসারের বাড়তি আয় জোগাতে দুই বছর ধরে ময়লার ভাগাড় থেকে এসব সংগ্রহ করেন তিনি। দিনে আয় হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
সুরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সুমি বললেন, গরীবদের সুরক্ষাব্যবস্থার দরকার হয় না, ওসব লাগে বড়লোকদের। দুবছর ধরে কাজ করলেও কোনো বড় অসুখে ভোগেননি বলে দাবি করেন তিনি।
একই পেশায় জড়িত মোছা. আশিদা বেগম (৫২)। বাস করেন শহরের রেলস্টেশনের ঝুপড়ি ঘরে। স্বামী নেশায় জড়িয়ে পড়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে আর একসাথে থাকেন না। যখন তার ১২ বছর বয়স তখন জন্মস্থান গোবিন্দগঞ্জ ছেড়ে বগুড়া চলে আসেন। সংসারে ছয় ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেরা বিয়ে করায় নিজ নিজ সংসার সামলান। অন্যদিকে শহরের বিভিন্ন ময়লা ট্রান্সফার স্টেশনে কাগজ, প্লাস্টিক, পলিথিন কুড়িয়ে সেসব বিক্রি করেন হাড্ডিপট্টির রশিদুল ও দোলনের কাছে। দিনে আয় করেন ২০০-৩০০ টাকা।
আরেকজন দুলালী বেগম (৩০) স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে তার সংসার। স্বামী পেশায় একজন রিক্সাচালক আর তিনি ময়লা ট্রান্সফার স্টেশনে কাগজ, প্লাস্টিক, পলিথিন কুড়ানোর কাজ করেন। থাকেন শহরের হাড্ডিপট্টিতে ভাড়া বাড়িতে। আগে থাকতেন রেলস্টেশনের ঝুপড়িতে। দুলালীর দৈনিক আয়ও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
ময়লা ট্রান্সফার স্টেশনে কাজ করার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও সে সম্পর্কে তারা কেউ জানেন না। সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করেন প্রতিটা দিন।
কমিউিনিটি ডেভেলপমেন্ট লার্নিং সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুল খালেক জানান, এ ধরণের মানুষগুলোকে নিয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। ফলে এদের জীবনমান তেমন উন্নত নয়। তবে এরা বর্তমানে সরকারি কিছু ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন।
নগরের পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের বেশ বড় ধরনের ভূমিকা আছে বলে মনে করেন আব্দুল খালেক। তবে তাদের ভিন্ন সংকট পোহাতে হয়।
আব্দুল খালেক জানান, যারা ময়লা-আবর্জনা কুড়ানোর কাজ করেন তারা তাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে চাইলেই অন্য কোনো পেশায় যেতে পারেন না। বা তাদেরকে অন্য কাজে নেয়া হয় না।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকতা ডা. সামির হোসেন মিশু জানান, সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া এ ধরনের কাজে সংক্রামিত হয়ে নানা রোগে ভুগতে পারে। পানিবাহিত, খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, তাদেরকে নিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে তাদের কাছে প্রচার করা গেলে তারা এ ঝুঁকি থেকে সজাগ থাকতে পারবে। সচেতনতা ছাড়া উপায় নেই। ‘গরীবরা অসুখে ভোগে না’ এমন প্রশ্নে ডা. মিশু বলেন, উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের ইমিউনিটি ক্ষমতা ভালো। যে কারণে ময়লার ভাগাড়ে কাজ করলেও শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভালো থাকায় সহজেই আক্রান্ত হন না । তবে স্বাস্থ্যঝুঁকি তো রয়েছেই, ফলে যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন।