
বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলী গ্রামের নবান্ন মেলা।
ভোরের আলো ফোটার আগে হাঁক-ডাকে বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলী গ্রাম হয়ে উঠেছে সরগরম। কারণ নবান্ন। এ উৎসবকে ঘিরে প্রায় ২০০ বছর ধরে শুধু একদিনের জন্য উথলী গ্রামের হাটটিতে জমে ওঠে বিশাল মাছের মেলা। তবে এতে নতুন সবজি থেকে শুরু করে মিষ্টিসহ সব কিছুই মিলে এখানে।
মেলা আগত স্থানীয়রা জানায়, বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে গত বুধবার ছিল পহেলা অগ্রহায়ণ। কিন্তু এ মেলায় সনাতনীদের পঞ্জিকা অনুসারে দিন নির্ধারণ করা হয়। এই পঞ্জিকায় শুক্রবার পহেলা অগ্রহায়ণ। এ জন্য ভোর থেকে জমে উঠেছে মেলা।
নবান্ন মেলা উপলক্ষে শিবগঞ্জ উপজেলার উথলী, রথবাড়ি, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, গনেশপুর, রহবলসহ অন্তত ২০ গ্রামের মানুষ ঘরে উৎসবের আয়োজন করে। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠেন।
উথলী গ্রামের বাসিন্দা শ্রী প্রদেশ কুমার মোদক বলেন, ‘আমার দাদাদের গল্প শুনেছি অগ্রহায়ণের পহেলা তারিখে এ মেলা করেছেন। আর কোথাও এমন মেলা হয় না।অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন মেলায় কেনা-কাটা করতে আসে।’
একই গ্রামের বাদশা আকন্দ বলেন, ‘লবান্ন (নবান্ন) বাজার উপলক্ষে আমরা কয়েক কুটুম্বদের দাওয়াত করি। আমরা এখানে কোনো রিদ (ঈদ) চেয়ে এই লবান্নের বাজারে বেশি মজা করি। এখানে বড় মাছ, তরি-তরকারি, বড় বড় মানকচু ওঠে। এগুলোই সবাই কিনে নিয়ে যায়।’
মেলায় মেয়ে-ভাগ্নী নিয়ে ঘুরছিলেন উপজেলার মোকামতলার বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম। জানালেন, মেলা উপলক্ষে আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াতে এসেছেন। মেলায় মাছ-মাংসসহ দরকারি সব কিছু পাওয়া যায়। এ জন্য গ্রামীণ এই মেলা ভালো লাগে তার।
মেলা ঘুরে দেখা যায় বিভিন্ন পন্যের প্রায় ২০০টি দোকান নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এর অর্ধেকই মাছের দোকান। অনেকে জমি থেকে নতুন তোলা শাক-সবজির পসরা নিয়ে এসেছেন মেলা চত্বরে। এ ছাড়া মুড়ি-মুড়কি, মিষ্টান্ন দ্রব্যের দোকানিরা তো আছেই। এ দোকানীরা আশেপাশের হাট-বাজারে নিয়মিত ব্যবসা করেন। তবে সারা বছর এই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকেন তারা।
মাছ ব্যবসায়ী শাহিদুল বলেন, ৩০ বছর ধরে এ মেলায় ব্যবসা করছি। তবে এবার মেলায় পাইকারী বাজারটা বেশি। কিন্তু ক্রেতা আসছে, দাম করে চলে যাচ্ছে।
মেলায় স্বাদু পানির প্রায় সব ধরনের মাছ উঠলেও বিগহেড ও সিলভার কার্প বেশি বিক্রি হয় বলে জানান সাইদুর রহমান নামে আরেক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমরা প্রতি কেজি সিলভার কার্প ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছি। বিগহেড ৪৫০ থেকে ৫০০, কাতল ৪০০ থেকে ৫০০, রুই ৩৫০, মৃগেল ২৫০, হাঙ্গেরি ৩৫০, কালবাউস ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
মেলায় আগত এক দর্শনাথী খায়রুল ইসলাম বলেন, ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ৮ কেজি ওজনের বিগহেড মাছ কিনেছি। এবার মাছের বাজার একটু বেশি মনে হয়েছে।
তার সঙ্গে থাকা শ্রী সুভাষ চন্দ্র বলেন, ৫০০ টাকা দিয়ে রুই মাছ কিনেছি। এ ছাড়া মিষ্টি, রসমালাই, দই কিনেছি। আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তারা বাড়িতে এসেছেন।
মেলার গোড়াপত্তন নিয়ে আলাপ হয়। জানা যায়, মেলাটি প্রায় ২০০ বছরের পুরাতন। শিবগঞ্জ কৃষি নির্ভর এলাকা। এ জন্য ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন জমিদার বুৎসিংহের কাছে স্থানীয়রা একটি হাট স্থাপনের দাবি করে। প্রজাদের কথা শুনে জমিদার প্রায় ৫২ বিঘা জমি হাটের জন্য দান করেন। সেই থেকে পহেলা অগ্রহায়ণে এখানে নবান্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় থেকে নবান্নের জন্য নতুন সবজি, মাছ ক্রয় করার রেওয়াজ তৈরি হয়।
এসব কথা জানান উথলী হাটের ইজারাদার ও মেলার আয়োজক আজিজুল হক। তিনি বলেন, এটা সনাতন ধর্মের লোকজনদের হাতে শুরু হলেও এখন সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে এই উৎসব পালন করে। সবাই আত্মীয়-স্বজন, মেয়ে জামাইদের দাওয়াত করে। নবান্ন উপলক্ষে এখানে এক দিনে প্রায় দেড় কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এর মধ্যে কোটি টাকার শুধু মাছই বিক্রি হয় মেলায়।
সহযোগিতায়: রবিউল ইসলাম ও আব্দুল আউয়াল।