Joy Jugantor | online newspaper

রংপুরে কেজি দরে তরমুজ, দাম নাগালের বাইরে

 রংপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮:৪৪, ১৪ মার্চ ২০২৩

রংপুরে কেজি দরে তরমুজ, দাম নাগালের বাইরে

মৌসুমের শুরুতে রংপুরের বাজার গুলোতে এবারও নিয়ম ভেঙে কেজি মাপে তরমুজ বিক্রি করেছেন খুচরা বিক্রেতারা।

সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের দরজায় কড়া নাড়ছে আত্মসংযমের মাস পবিত্র মাহে রমজান। রমজানে রোজাদারদের ইফতারে বেশি চাহিদা থাকে শরবতসহ রসালো ফলের।

বাংলার চৈত্র আর বৈশাখ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে এবারে আরবী মাস রমজান। আর তাই এই গরম আবহাওয়ায় চাহিদা বেশি থাকে তরমুজের। সেই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে তরমুজ বিক্রয়ে খুচরা পর্যায়ে চলে নানা কারসাজি। তার মধ্যে অন্যতম হলো কেজিতে  বিক্রয়! যাতে একটি তরমুজের দাম হয় পাইকারি থেকে খুচরায় দ্বিগুণ।

রমজানের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মৌসুমের শুরুতে রংপুরের বাজার গুলোতে এবারও নিয়ম ভেঙে কেজি মাপে তরমুজ বিক্রি করেছেন খুচরা বিক্রেতারা। অথচ যে পদ্ধতিতে ক্রয় সেই নিয়মে পণ্য বিক্রির বিধান রয়েছে ভোক্তা অধিকার আইনে। কৃষক থেকে পাইকাররা পিস হিসেবে তরমুজ কেনেন। কিন্তু বেশি লাভের আশায় খুচরা বাজারে অন্যায়ভাবে সেই তরমুজ কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। ফলে সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে গেছে মৌসুমী এই ফলটি।

তরমুজ উৎপাদনখ্যাত বরিশাল অঞ্চলের কৃষক-পাইকার আর রংপুর অঞ্চলের খুচরা বাজারগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৮-১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ বর্তমানে রংপুর নগরীতে বিক্রি করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। অথচ পাইকারি বাজারে এই সাইজের তরমুজের দাম সর্বোচ্চ ১৯০ থেকে ২১০ টাকা। উৎপাদক পর্যায়ে গেলে তা আরও কম। পুরো বিষয়টিকেই খুচরা বিক্রেতাদের কারসাজি বলছেন পাইকার আর ক্রেতারা। গত দুই থেকে তিন বছর ধরে ভোক্তা অধিকার আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই পদ্ধতিতে তরমুজ বিক্রি চলছে রংপুরে। কী করে এই সিন্ডিকেট তৈরি হলো তারও উত্তর মিলছে না। মাঝখান থেকে দেশে উৎপাদিত এই সুমিষ্ট ফলটির স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

গত বছর বিশেষ করে রমজান মাসে কয়েক দফায় কেজি দরে দ্বিগুণ দামে তরমুজ বিক্রয়ের বিষয়ে রংপুরের ভোক্তা অধিকার ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালান। ফলে গত বছর সব শেষ আকারভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল তরমুজ। এবার মৌসুমের শুরুতে বরিশাল অঞ্চলের তরমুজে সয়লাব হয়েছে রংপুরের বাজারগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত মৌসুমী এই ফল বিক্রয়ের কারসাজি রোধে চোখে পড়েনি কতৃপক্ষের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা।

সোমবার বিকেলে রংপুর নগরীর সিটি বজার, মেডিকেল মোড়, সাতমাথা বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের সবুজ আর কালো তরমুজে সয়লাব হয়েছে। বিক্রেতারা এই তপ্ত গরমে হাঁকডাকে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছেন। কেউ আবার তরমুজের মাঝখানে চাকু দিয়ে লাল টকটকে একচিলতে ফলা উল্টিয়ে সোপিচ করে রেখেছেন ক্রেতাদের বিশ্বাস স্থাপনে।

নগরীর সিটি বাজারের প্রবেশদ্বারের পাশে তরমুজ বিক্রেতা ষাটোর্ধ্ব রাজা মিয়া। সারি সারি করে স্তূপ করছেন সবুজ আর কালো তরমুজে। ক্রেতারা আসছেন আর তরমুজের দাম জিজ্ঞেস করছেন। রাজা মিয়ার চাওয়া ৫০ টাকা কেজি দরের কথা শুনে চলে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। দীর্ঘ আধাঘণ্টা রাজা মিয়ার দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে তরমুজ বিক্রয়ের দৃশ্য আমরা দেখলাম। এই আধাঘণ্টায় রাজা মিয়ার দোকানে ৫- ৮ কেজি ওজনের তরমুজ বিক্রি হয়েছে ৭টি। এই ৭ জনের তালিকায় চোখে পড়েনি একজনও সাধারণ মানুষ। কিন্তু তরমুজ দেখে দাম করেছেন ২৫-৩০ জন সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ।

রাজা মিয়ার দোকান থেকে ৬ কেজি ওজনের একটি তরমুজ কিনেছেন ঔষধ কোম্পানিতে চাকরিজীবী সামসুজ্জামান। কথা হলে সামসুজ্জামান বলেন, ‘বছরের শুরুতে এই ফল বাজারে এসেছে শুনে স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা বায়না ধরেছে আজ কিনে নিয়ে যাচ্ছি। দাম অনেক।  ছেলে মেয়েদের আবদার পূরণে বাধ্য হয়ে কিনলাম।' সামসুজ্জামানের মতো বাকি ৬ ক্রেতাও ছিল চাকরিজীবী। 

এ সময় সিটি বাজারে তরমুজ হাতে ধরে দাম করে না-কিনে ফেরত যাওয়া মনিরুজ্জামান বাবু নামের এক অটোচালক বলেন, ‘কয়েক দিন থেকে বাজারে তরমুজ দেখছি। কেনার ইচ্ছে মনে মনে পোষণ করেছি। কারণ আমার দুই মেয়ে তরমুজ খুব পছন্দ করেন। আজ এখানে দাম শুনে কেনার ইচ্ছে মরে গেছে ভাই। তরমুজের সাইজ এবং দাম অনুযায়ী একেকটা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। দিনে অটো চালিয়ে এই পরিমাণ আয় হয় আমার। একটা তরমুজ কিনলে দিনের বাজার সদাই একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বিধায় কেনা হলো না।’ 

বাবুর মতো অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ তরমুজ কিনতে এসে ক্ষুব্ধ হয়েছেন বিক্রেতার প্রতি। অনেকে কেজি দরে নয়, পিস হিসেবে কিনতে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে গেছেন দোকান্দারের সঙ্গে। ক্ষুব্ধ এসব ক্রেতারা বলছেন, রমজানের আগে যেভাবে কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে। না জানি রমজান মাসে এই তরমুজের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকে। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির প্রতিও জোর দাবিও করেছেন‌ তারা। 

এদিকে বরিশাল অঞ্চল থেকে ট্রাকে করে পিস হিসেবে পাইকারি দরে তরমুজ কিনে এনে রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে পাইকারিভাবে বিক্রি করা হাসিম উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মুঠোফোনে তরমুজের বাজার বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বরিশাল, ভোলা আর পটুয়াখালীতে এখন তরমুজের মৌসুম শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ থেকে আমি এখন থেকে তরমুজ কিনে এনে উত্তরাঞ্চলে পাইকারি বিক্রি করছি পিস হিসেবে। তবে সেটি খুচরা পর্যায়ে তারা কেজি দরে বিক্রি করে।’ 

দামের বিষয়ে হাসিম উদ্দিন জানান, ৮ থেকে ১২ কেজি ওজনের বড় সাইজের তরমুজ পাইকারি হিসেবে প্রতি ১০০ পিস ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এখানে। এছাড়াও ৭-৫ কেজি ওজনের তরমুজ ১০০ পিস পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ হাজার টাকা।
ছোট সাইজ ২-৪ কেজি ওজনের সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা প্রতি ১০০ পিস।

তরমুজ ব্যবসায়ী হাসিম উদ্দিনের তথ্যানুযায়ী ৮ কেজি ওজনের উপরে বড় সাইজের তরমুজটি পাইকারি পর্যায়ে দাম থাকে ২০০ টাকা। সেটি রংপুরের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। মধ্যম সাইজের ৪-৬ কেজি ওজনের পিস হিসেবে পাইকারি দরে ৬০-১০০ টাকা হলেও সেটি বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে।

সিটি বাজারে খুচরা পর্যায়ে তরমুজ বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ থেকে আমরা ৫০ টাকা কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করছি। বেচা বিক্রি খুবই কম।’ 

কেজিতে তরমুজ বিক্রির বিষয়ে মনির বলেন, ‘আমরা এই শহরের ইঞ্জিনিয়ার পাড়া ও সিটি বাজর আড়ৎ থেকে কেজি দরে কিনেছি,  তাই কেজিতে বিক্রি করছি। মহাজনরা আমাদের পিস হিসেবে দিলে আমরাও পিস হিসেবে বিক্রি করব।’ 

দক্ষিণাঞ্চলে পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে এখানকার চেয়ে অর্ধেক দামে এই ব্যবধানের বিষয়টি জানতে চাইলে রাজা মিয়া নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজ কি হিসেবে আর কত দামে বিক্রি হচ্ছে, তা আমরা জানি না। আমরা এখানে মহাজনদের কাছে যে হিসাবে কিনি; তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বিক্রি করি। বাকিটা মহাজনেরা জানেন। তাদের জিজ্ঞেস করেন।’ 

সিটি বাজারের রুবেল নামের এক বিক্রয়কারী মহাজনের সঙ্গে কথা বললে উল্টো রাগ দেখিয়ে বলেন, ‘ভাই দক্ষিণ অঞ্চলে তরমুজের দাম অনেক কম। আপনি কিনে এনে ব্যবসা শুরু করেন।’ 

রংপুর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন জানান, বিক্রির পদ্ধতি সম্পর্কে আইনে কিছু বলা না থাকলেও পাইকারি দরের চেয়ে খুচরা বাজারের দরে কতটা পার্থক্য থাকতে পারে তা স্পষ্ট বলা আছে। তরমুজের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি বেআইনি। দামের এতটা পার্থক্য করে পণ্য বিক্রির কোনো বিধান ভোক্তা অধিকার আইনে নেই। 

তিনি বলেন, ‘আগামী ১৫ মার্চ বিশ্বভোক্তা অধিকার দিবস। সে বিষয়ে আমরা একটু ব্যস্ত আছি। ১৫ মার্চের পর থেকে রংপুরে তরমুজ বিক্রির বিষয়ে আমরা বাজার মনিটরিং করব এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ দামের বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’