Joy Jugantor | online newspaper

বগুড়ায় ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর খুন: নেপথ্যে সভাপতি পদ? 

মাসুম হোসেন 

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ১৮ মার্চ ২০২১

আপডেট: ০৫:৩৫, ১৯ মার্চ ২০২১

বগুড়ায় ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর খুন: নেপথ্যে সভাপতি পদ? 

নিহত তাকবীর ইসলাম।

এক সঙ্গে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ছিলেন দুজন। শুরুটা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিকের হাত ধরে। শেষের দিকে ছিলেন এক নেতার অনুসারী। তবে শেষ ভালো হয়নি। ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেছে একজনের। তাকে হত্যার অভিযোগ আরেকজনের বিরুদ্ধে। নেতারা বলছেন, ‘সভাপতি পদ’-ই হত্যার নেপথ্যে। 

নিজ দলীয় নেতা তাকবীর ইসলাম খানকে হত্যার অভিযোগ বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে। তাকবীর বগুড়া জেলা ছাত্রীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাকবীর মারা যাওয়ার পর গত মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) রউফকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। 

ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ নেতাদের বর্ণনায় সেদিনের ঘটনা

গত বৃহস্পতিবার ( ১১ মার্চ) জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক তিতাস ও সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় বগুড়ার ধুনট উপজেলায় যাচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রউফ ও তাকবীর ইসলাম। তারা সবাই মোটরসাইকেলযোগে যাচ্ছিলেন। তারা গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ি এলাকায় পৌঁছালে সেখানে তাকবিরের মোটরসাইকেলের সঙ্গে আব্দুর রউফের সমর্থক জাহিদ হাসানের মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এক সময় জাহিদের পক্ষ নিয়ে এগিয়ে আসেন আব্দুর রউফ। ওই সময় সভাপতি তিতাস ও সাধারণ সম্পাদক অসীম তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার মিমাংসা করে দেন।

তারা ধুনট উপজেলায় গিয়ে তাদের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি শেষ করে বগুড়ার শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু গাবতলীর বাগবাড়িতে মোটরসাইকেলের ধাক্কার রেশ রয়ে যায়। এ কারণে অনুষ্ঠান শেষে রউফের আগেই রওনা দেন তাকবীর ও তার সহযোগীরা। তারা আগে এসে শহরের বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজের সামনে অবস্থায় নেন। তারা আব্দুর রউফের পথ আটকে তাকে মোটরসাইকেল ধাক্কা নিয়ে বাকবিতণ্ডার প্রতিশোধ নিবেন বলে ছাত্রলীগের একাধিক নেতা দাবি করেন। 

তবে তাকবীরের এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় রউফের ভিন্ন সমীকরণের কারণে।  রউফ ঘটনা বুঝতে পেরে শহরে ঢোকার ওই পথ পরিবর্তন করেন। শহরে ঢোকেন বনানী থেকে প্রথম বাইপাস হয়ে ফুলদিঘী হয়ে। 

এরপর তাকবীরও তখন পরিকল্পনা পরিবর্তন করেন। তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার সহযোগীদের নিয়ে শহরের সাতমাথায় আ.লীগের দলীয় কার্যালয় এলাকায় অবস্থান নেন। আব্দুর রউফ দলীয় কার্যালয়ে আসলেই তার ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাকবীরের। এ বিষয়টিও জানতে পারেন রউফ। তিনি সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে না এসে রাতে তার সহযোগীদের সঙ্গে সাতমাথায় আসেন। তখন মুখোমুখি হন আব্দুর রউফ ও তাকবীর। শুরু হয় তাদের বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে বাকবিতণ্ডা রুপ নেয় সংঘর্ষের। ওই সময় আহত হন অন্তত দুই গ্রুপের ৯ জন। ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন তাকবীর।

পরে মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) বিকেল ৩ টার দিকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

তবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকবীরের এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে তাকবীর বলেন, ‘আমার ডান পায়ে হাঁটুর নিচে ফ্র্যাকচার হইছে। ওখানে এসএস পাইপ দিয়ে আর রড দিয়ে মারছে; চাপাতি দিয়ে আঘাত করছে। বাঁ হাতের কজ্বিতে আর কনুইয়ের মাঝখানেও মারছে, সেখানে ফ্র্যাকচার হইছে, ওখানে দুটা সেলাইও পড়ছে। মাথার পেছনে চারটা সেলাই পড়ছে, ওখানে চাপাতি দিয়ে আঘাত করছে। আমার কোমরের পাঁজরের নিচে দুই পার্শ্বেই দুটি স্টেপ (ছুরিকাঘাত) করেছে, আট ইঞ্চি করে ক্ষত হইছে। চার চারে আটটা সেলাই পড়ছে,  স্টেপটা রউফ নিজেই করছে। শরীরে আরো অনেক জায়গায় ক্ষত হইছে, পুরো শরীরে পিটিয়েছে।’

সংঘর্ষের ঘটনায় সদর থানায় দুটি পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের হয়। গত শনিবার পৃথক দুটি মামলা হয়। একটির বাদী তাকবীর ইসলামের মা আফরোজা ইসলাম। অন্যটির বাদী আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য সোহাগ হাসান।

ছাত্রলীগ নেতা তাকবীরের মায়ের করা মামলায় রউফকে প্রধান আসামী করা হয়। সোহাগের মামলায় প্রধান আসামী করা তাকবীরকে। মামলার পর অবশ্য পুলিশ কোনো পক্ষেরও আসামী ধরতে পারেনি গত বুধবার পর্যন্ত। তবে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকবির মারা যাওয়ার পর। মঙ্গলবার তাকবির মারা যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার ভোরে আলআমিন নামের একজকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, এই হতাহতের বিষয়টি আসলে মোটরসাইকেলে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে নয়। এটি শুরু হয়েছে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের আগামী কমিটির সভাপতি কে হবে সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। 

জেলা ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, গঠনতন্ত্র মতে জেলা ছাত্রলীগ কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৩ মে এ কমিটি গঠন করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সামনে নতুন কমিটির সম্মেলন হওয়ার কথা। 

ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের আগামী কমিটিতে সভাপতি পদে তাকবীর ও রউফ দুজনেই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। 

জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসলাম হোসেন বলেন, ‘রউফ এক সময় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল রাজী জুয়েলের সঙ্গে রাজনীতি শুরু করে। পরে এসে রউফ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তিতাসের সঙ্গে রাজনীতি শুরু করে।’ 

তবে রাজনীতির শুরু থেকেই তিতাসের খুব ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত তাকবীর ইসলাম খান। পরে তাকবীর ও আব্দুর রউফ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনুর সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পান। এক পর্যায়ে আসন্ন জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে এ দুজনই সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার এটিও প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা। 

রউফ ও তাকবীরের মধ্যে কোনো কোন্দল ছিল না দাবি করে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় জয়যুগান্তরকে বলেন, ‘তাদের দুজনের মধ্যে সভাপতি হওয়ার মনোবাসনা হয়েতো ছিল। কিন্তু এটা আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। এভাবে ছাত্রলীগের এক নেতা খুন হওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি ছাত্রলীগের জন্য ক্ষতি, আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতি, দেশের জন্যও ক্ষতি।’ 

জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক তিতাস বলেন, বৃহস্পতিবার মোটর সাইকেলের ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। ওই সময় আমি ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় ওই ঝামেলা মীমাংসা করে দেই। এরপরে আমরা আর কিছুই জানিনা। এছাড়া ওই মারপিটের ঘটনা ঘটেছে সাতমাথা এলাকায়।

তিনি বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যারা জড়িত রয়েছে, আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাশরাফি হিরো বলেন, ‘হত্যা বা খুন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সংস্কৃতি নয়। দলীয়ভাবে আমরা এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়  ব্যবস্থা নিব। আমরা চাই হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দেয়া হোক।’