Joy Jugantor | online newspaper

অনলাইন ক্লাসের পর এবারে অনলাইন এক্সাম, কি চায় পবিপ্রবিয়ানরা?

চৈতী রায় বৃষ্টি

প্রকাশিত: ১৪:৩২, ২৯ মে ২০২১

আপডেট: ১৪:৩৩, ২৯ মে ২০২১

অনলাইন ক্লাসের পর এবারে অনলাইন এক্সাম, কি চায় পবিপ্রবিয়ানরা?

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে ছোটবেলা থেকে এ মন্ত্র শোনেনি এমন খুব কম-ই আছে! তবে কেউ কি জানতো গাড়ি-ঘোড়া নয় একদিন লেখাপড়ার চাকাটাই সত্যি সত্যি এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে! করোনা অতিমারির কারণে বিশ্বজুড়ে বেহাল দশা।  এ সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় দেড় বছর ধরে থমকে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকা। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, গৃহবন্দি শিক্ষার্থীদের জীবনে আজ কেবলই হতাশা।  হই হুল্লোর, কোলাহলে মুখরিত ক্যাম্পাস ও যেন আজ নীরবে অপেক্ষার পালা শেষের প্রহর গুনছে। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে বিবর্ণ চোখে চেয়ে রয়েছে আগামী প্রজন্ম। 

এরই মাঝে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন ক্লাস, এক্সামের মাধ্যমে দীর্ঘ সেশনজট কাটিয়ে উঠতে পারলেও করোনার বিষধর ছোবলের মুখে পড়েছে পাবলিকিয়ানরা।  দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে প্রায় দেড় বছরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এতদিনে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শোনা যাচ্ছে অনলাইন পরীক্ষার গুঞ্জন।

এ বিষয়ে কী ভাবছেন পবিপ্রবিয়ান'রা? এতদিনের সেশনজট কিভাবে হবে পূরণ!  সশরীরে এক্সাম হল নাকি অনলাইন মাধ্যম কোনটি বেছে নিতে চান তারা? বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশকিছু শিক্ষার্থীদের সাথে।

অনলাইন পরীক্ষা নিয়ে কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী প্লাবন সাহা বলেন- করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ বন্ধের কবলে পড়ে আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি। এ অবস্থায়  পরীক্ষাগুলো অনলাইনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলেও সেখানেও রয়েছে জটিলতা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মফস্বল এলাকা থাকেন।  সেখানে নেটওয়ার্কজনিত সমস্যার পাশাপাশি উন্নত ডিভাইস ক্রয়ক্ষমতা এবং অধিক মূল্যের ডাটাপ্যাকের সমস্যাতো আছেই। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেমিস্টার অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছি। যেখানে শপিংমল, কারখানা, যানবাহন সবই চালু রয়েছে সেখনে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে করোনা প্রতিরোধের সিদ্ধান্তটা নিতান্তই হাস্যকর।  

আর যদি অনলাইনেই পরীক্ষা নিতে হয় তাহলে এতোদিন এই সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়নি যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকগুলো সেমিস্টারই অনলাইনে পরীক্ষা নিয়ে শেষ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় সকলের ভেতরই মতামতের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী হিসেবে এটা কোনভাবেই চাচ্ছি না যে পড়াশোনার সাথে একটা গ্যাপ সৃষ্টি হোক । এ কথা জানান বিজনেস অ্যাডমেনিসট্রেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট অনুষদের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী রেজওয়ানা হিলেম।  

তিনি জানান, করোনাকালীন এ পরিস্থিতির জন্য একটা বিশাল সেশন জটের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এবং এর ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা থেকে অনেকটা দূরে। তাই দেখা যাচ্ছে পড়াশুনার প্রতি এখন একটা অনীহা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী সন্তান এবং সচেতন তাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে উচিত স্ব-শরীরে পরীক্ষা নেওয়া । যদি একান্তই সম্ভব না হয় স্ব-শরীরে পরীক্ষা নেওয়া তাহলে উচিত অন্তত অনলাইনে হলোও পরীক্ষা নেওয়া যেন এই অনলাইন পরীক্ষা এবং স্ব-শরীরে পরীক্ষা এটা নিয়ে এরকম একটা বিতর্ক চলতেই থাকলে যদি পরীক্ষা কোন উপায়  না হয়, তাহলে দেখা যাবে  আরও সেশন জটের বড় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে সবার জন্য।

 

নিউট্রিশন এন্ড ফুড সাইন্সের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী  উম্মে সাঈদা বলেন - আমরা বর্তমানে অনেকটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। একেই চলছে মহামারী করোনা, তার উপরে দক্ষিণাঞ্চলে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ডায়রিয়ার প্রকোপ কমতে না কমতেই দেখা দিয়েছে ঘূর্নিঝড় ইয়াস। পারিবারিক দূরাবস্থাসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের জীবন। এসবের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার অস্থিতিশীল সিদ্ধান্ত যেন আমাদের হতাশা বহুগুন বৃদ্ধি করেছে। বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের। যেখানে কাঙ্ক্ষিত সিজিপিএ তে পৌঁছানোর জন্য শেষ বর্ষটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ থাকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য, সেখানে আমরা এখন কোনোরকম পাস করা নিয়ে চিন্তা করছি।  সবকিছুর বিবেচনায় অনলাইন পরীক্ষার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া অনেকটা কঠিন।  যেখানে অনলাইনের ক্লাসগুলোই ঠিকমত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হচ্ছে না সেখানে এই নতুন পদ্ধতির অনলাইন পরীক্ষা কতটা কার্যকরী হবে প্রশ্ন রয়ে যায়। 

উম্মে সাইদা মনে করছেন, ব্যবহারিক দক্ষতা ব্যতীত এই অনলাইন পরীক্ষার সার্টিফিকেট ভবিষ্যত চাকরি জীবনে কতটা সহায়তা করবে সংশয় থেকে যাচ্ছে।  তবুও জাতির মেরুদণ্ডকে টিকিয়ে রাখতে এবং সেশন জট থেকে উত্তরণ পেতে যদি যথাযথভাবে ক্লাসগুলো নিয়ে গুরুত্ব সহকারে অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আমাদের অনিশ্চিত এই জীবন থেকে মুক্তি মিলবে। যানবাহন-বাজারঘাট সবকিছুই যেহেতু চলছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বশরীরের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হলে আমাদের সবার জন্য সুফল বয়ে আনবে মনে করছি। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন গুরুত্বসহকারে আমাদের শিক্ষার্থীদের সার্বিক অবস্থা ভেবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিবে বলে আশা করছি।

এই অনুষদের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহ্ মোঃ মাসনুন আলমের বক্তব্য, অনলাইন পরীক্ষা আসলে আমাদের জন্য না যেহেতু বাংলাদেশে ইন্টারনেট সবজায়গায় সুলোভ না।  আমাদের অনেক সহপাঠী আছে যারা ইন্টারনেট এর অভাবে ক্লাসই করতে পারেনি।তাদের রেখে পরীক্ষা দেওয়াটা তাদের ধোঁকা দেয়া হবে। সরকার এর উচিত ভার্সিটিগুলো খুলে দেওয়া। যেন রিভিউ ক্লাস শেষে দ্রুত স্ব-শরীরে  পরীক্ষা দেওয়া শুরু করা যায়। জানি করোনার বাহানা দেওয়া হয় খোলার কথা উঠলেই, কিন্তু সরকার কি এর মাধ্যমে বুঝাতে চায় সব মানুষ ভার্সিটির শিক্ষার্থী থেকে সচেতন? যেহেতু সব খোলা শুধু শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান এর কথা উঠলেই করনার বাহানা দেওয়া হয়। আশা করি নিয়ম মেনে ক্লাস করলে আক্রান্ত হবে না কেউ।

একই অনুষদের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী শান্তা মারিজম বলেন – ১ বছর ৪ মাস সেশন জট! একজন বিশ্ববিবিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর জন্য কত বড় বোঝা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কাম্য। প্রায় দেড় বছরের ক্ষতি যেন তাদের চাকরি ক্ষেত্রের বয়সে প্রভাব না পরে সেদিক টাও শিক্ষা মন্ত্রনালয় খতিয়ে দেখবে বলে আশা রাখছি।

বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে শান্তা মারিজমের ভাষ্য, এখানে যারা পড়ে তারা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং প্রাপ্তবয়স্ক। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্য সব কিছু চলতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয় আটকে রাখার কোন যুক্তি আমি দেখি না।

তিনি জানান, ২৫% শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে ঝড়ে গিয়েছে।  তার মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।  সংখ্যাটা যাতে আর না বাড়ে সে দিকে কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি।

অনলাইন পরীক্ষা, ক্লাস নিয়ে আমার নেগেটিভ কোন মন্তব্য নেই।  কেন না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সব শিক্ষার্থীকেই কোন না কোনভাবে স্মার্টফোনের সান্নিধ্য নিতে হয়েছে। তাই তারা এ ব্যাপারে একেবারে নতুন নয়। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি অনলাইনে ক্লাস,পরীক্ষা নিয়ে সেশন জট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে সেখানে আমরা কেন থেমে আছি? অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন সবার কি সমান সুযোগ আছে? বা সবার সামর্থ্য কি সমান?

এখন আর এসব প্রশ্নের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে থাকার সময় নেই। ভুলে গেলে চলবে না 'প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক'। তাই অতিশীঘ্র এভাবে হোক বা সেভাবে হোক! যেকোন ভাবেই হোক শিক্ষার্থীদের এই অভিশাপ মুক্ত করা দাবি করেন শান্তা। 
ব্যক্তিগতভাবে অনলাইন পরীক্ষার পক্ষে নয় কৃষি অনুষদের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সৈয়দা ইবতিহাল।  তার কারন হিসেবে বলেন- ৩য় সেমিস্টারের ক্লাস পুরাই বলা যায় অনলাইনে করছি। ক্লাসের সময় স্যারেরা বলেছিলেন,  রিভিউ ক্লাস নিবেন। এখন, রিভিউ ক্লাস ছাড়া এইভাবে অনলাইন এক্সাম এ কিভাবে বসি? তারপর অনেক টপিকই আমাদের কাছে ক্লিয়ার না।
অনেক স্যারেরা এখনো বেশ কিছু শীট এর পিডিএফ ই সাপ্লাই দেন নাই। ক্যাম্পাসে গিয়ে দিবেন এই বলে আশ্বাস দিয়ে।

এমসিকিউ সিস্টেম হলে সেক্ষেত্রে আমাদের এই পড়াশোনায় এমসিকিউ এর কোনো ধারণাও নাই। তাছাড়া প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট দের ওদের স্যারেরা অনেক রকম শর্ট সিলেবাস করে দেন। আমাদের স্যারেরা দিবেন? 

এসাইনমেন্ট যদি হয় শুধু তাহলে সেটা বলা যায় ঠিক আছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে ইবতিহাল জানান, তিনি অনলাইন এক্সামের বিপক্ষে।  স্যাররা কোনোভাবে এইবারের লক ডাউনটা উঠালে আমরা সামনাসামনি গিয়ে এক্সাম দিতে রাজি।
তাছাড়া আমার কথা হলো এক্সাম যখন অনলাইনেই দিব তাইলে কেন এতদিন অপেক্ষা করলাম! সেই শুরু থেকে নিলেই তো এখন এই জট তৈরি হত না। এ ক্ষতিপূরণ কিভাবে করবে প্রশাসন?

পক্ষে-বিপক্ষে সবার মতামত থেকে কিছুটা হলেও স্পষ্ট যে অনলাইন নয় স্ব-শরীরে পরীক্ষার হল রুমকেই বেছে নিতে চায় অধিকাংশ পবিপ্রবিয়ান। যদিও শিক্ষার্থীদের একাংশ চলমান দীর্ঘ সেশনজটের কথা বিবেচনায় অনলাইন এক্সাম দিতে ইচ্ছুক। তবে সেক্ষেত্রে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় শর্ট সিলেবাস ও এসাইনমেন্ট পদ্ধতিটিকেই প্রাধান্য দেয়া যুক্তিযুক্ত। 

তবে সর্বস্তরেই একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে বারবার আর কত? স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারে খুলে দেওয়া হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

লেখক: কৃষি অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী,

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়