বিলুপ্তির পথে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ‘নল বড়শি’
কয়েক দশক আগেও বর্ষার পানি কমলে গ্রামীণ জলাশয়ের ধারে সারি সারি বাঁশ কিংবা পাটখড়ির নল পুঁতে মাছ ধরার দৃশ্য দেখলে মন ভরে যেত। মাঠ-খেত পেরিয়ে, নদী-খাল ঘুরে হেঁটে গেলে চোখে পড়ত মাছ শিকারের নির্ভরযোগ্য একটি পদ্ধতি নল বড়শি। কিন্তু সময় বদলে গেছে। আধুনিক জাল-ফাঁদ আর জলাশয় হারানোর ফলে ফুলবাড়ীতে এখন আর আগের মতো দেখা মেলে না এই ঐতিহ্যের। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনের পরিচিত এই উপকরণ।একসময় বর্ষা কিংবা শরৎকাল জুড়ে স্থানীয় জেলেরা শুকনো পাটখড়ি বা চিকন বাঁশের কঞ্চিতে সুতা আর বড়শি বেঁধে জলাশয়ে গেঁথে রাখা হতো সারি সারি। বাড়তি খরচ লাগত না, প্রয়োজনও পড়ত না জটিল কোনো সরঞ্জামের। সহজ-সরল এই পদ্ধতিতে শোল, বোয়াল, টাকি কিংবা আইড়সহ নানা ধরনের দেশি মাছ ধরা যেত।
বাড়ির ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে কৃষক-জেলে সবার দিন কাটত মাছ শিকারের উত্তেজনায়।কিন্তু সময়ের ব্যবধানে খাল-বিল শুকিয়ে গেছে, নদী সঙ্কুচিত হয়েছে, দেশি মাছও কমে গেছে। নল বড়শি আর মানুষের মনে রোমান্টিক স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে।কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীর পশ্চিম ফুলমতি বারোমাসিয়া নদীর ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ী আজিবর রহমান প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক ডজন নল বড়শি বসান। ভোরে গিয়ে তুলেন। তার কথায়, ‘আগে এই বড়শিতে ভালো মাছ উঠত। এখন কোনদিন একটা মাছ পাই, আবার কোনদিন একটা মাছও না। নল বড়শি আর নেট জাল দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে।’সীমান্তঘেঁষা কুরুষাফেরুষা এলাকার কৃষক ও মাছ চাষি ধীরেন্দ্র নাথ রায় যেন শৈশব মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কমপক্ষে ২০ বছর পর আপনার মুখে নল বড়শির কথা শুনলাম। আগে দোলায় নিয়ে গিয়ে মাছ তুলতাম। এখন খাল-ডোবা নেই, মাছ নেই। নল বড়শি এখন ইতিহাস।’
আরেক কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘শৈশবে খাওয়া-দাওয়া শেষে শত শত নল বড়শি নিয়ে বের হতাম। চ্যাং, চ্যাংটি, শোল, মাগুর কত দেশি মাছ ধরতাম! এখন সেসব নেই বললেই চলে। তাই নল বড়শিও প্রায় বিলুপ্ত।’ফুলবাড়ী উপজেলার নদ-নদী কিংবা জলাশয়ের চিত্রও বলছে একই কথা। ধরলা, বারোমাসিয়া ও নীলকমল নদীসহ শিমুলবাড়ী ও ভাঙ্গামোড় অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় বিল-খালে একসময় নল বড়শির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। এখনো কিছু এলাকায় দেখা যায়, তবে মাছের সংকটে তার ব্যবহারও সীমিত।গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, মাটির গন্ধ আর নদীর ইতিহাস বহন করে চলা নল বড়শি যেন এখন স্মৃতির মলাটে বন্দী। নতুন প্রজন্মের অনেকে নামও শোনেনি, দেখতেও পায়নি। সময়ের ব্যবধানে গ্রামীণ সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হারিয়ে যেতে বসেছে। হয়তো ভবিষ্যতে বইয়ের পাতায় কিংবা গল্পে শুনে তবেই জানা যাবে নল বড়শির নাম।
