Joy Jugantor | online newspaper

চরম বর্বরতা দেখিয়ে, উল্লাস করে রূপলাল ও প্রদীপকে হত্যা করা হয়

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ১৪ আগস্ট ২০২৫

চরম বর্বরতা দেখিয়ে, উল্লাস করে রূপলাল ও প্রদীপকে হত্যা করা হয়

চরম বর্বরতা দেখিয়ে, উল্লাস করে রূপলাল ও প্রদীপকে হত্যা করা হয়

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় চোর সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার নতুন মোড় নিলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়,রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যখন বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ে আনা হয়, তখনো তারা জীবিত ছিলেন। তবে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও তাদের বাঁচাতে পারেনি।

নতুন ভিডিওতে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে একটি ভ্যানের ওপর রাখা হয়েছে রূপলাল ও প্রদীপকে। চারপাশে কয়েক শ মানুষ, প্রথম সারিতে তরুণ-যুবকেরা। পুলিশের চার সদস্য ভ্যানটি ঘিরে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছিলেন এবং হাত তুলে জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। এ সময় রূপলাল দাঁড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শোয়া অবস্থায় খুলে যাওয়া লুঙ্গি ঠিক করছিলেন তিনি। পুলিশ ধাক্কা দিয়ে জনতাকে সরানোর চেষ্টা করলে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। শোরগোল শুরু হলে পুলিশ পিটুনিতে অর্ধমৃত এই ব্যক্তিদের রেখে সরে যায়।

রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনির আগে হাত জোড় করে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান প্রদীপ লাল (বাঁয়ে)। নিজের পরিচয় বলছিলেন রূপলাল (ডানে)এদিকে এ ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে পুলিশের দুই এসআইসহ ছয় কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে তাদের পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। বুধবার (১৩ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে আট পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তের সত্যতা নিশ্চিত করেন রংপুরের পুলিশ সুপার আবু সাইম।সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- তারাগঞ্জ থানার এসআই আবু জোবায়ের, সফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল ফারিকুদ আখতার জামান, ধিরাজ কুমার রায়, হাসান আলী, ফিরোজ কবির, মোক্তার হোসেন ও বাবুল চন্দ্র রায়।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ চলে যাওয়ার পর রূপলাল মাথা তুলতেই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক তাকে ঘুষি মারেন। এতে  রূপলাল আবারও লুটিয়ে পড়েন। এরপর ভ্যানের ওপর শোয়া অবস্থায় থাকা দুজনকে তরুণ-যুবকেরা যে যেভাবে পারেন কিল, ঘুষি, লাথি, লাঠি ও রড দিয়ে মারতে থাকেন। এক পর্যায়ে ভ্যানের ওপর থেকে মাটিতে পড়ে যান প্রদীপ লাল। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে এ দৃশ্য ভিডিও করছিলেন অনেকেই।ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রদীপ লাল ভ্যান থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সেখানে তাকে অনবরত লাথি মারা হয়। রূপলালকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভ্যানসহ প্রদীপ লালের ওপর উল্টে দেওয়া হয়। এতে দুজনই ভ্যানের নিচে চাপা পড়েন। এরপর তাদের ওপরে থাকা ভ্যানে চাপ দিতে থাকেন তারা। এ সময় বাঁশির শব্দ শোনা গেলেও কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। 

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, এক পর্যায়ে ভ্যানটি কয়েকজন যুবক-তরুণ রূপলাল ও প্রদীপের ওপর থেকে সরিয়ে নেন। এরপর রশি, জুতা, গাছের ডাল, ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে মারধর করতে থাকেন। এ সময় রূপলাল ও প্রদীপ নিস্তেজ ছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলুদ, কালো, লাল গেঞ্জি পরা চার-পাঁচজন তরুণ-যুবক রূপলালের পিঠে লাথি মারতে থাকেন। হলুদ গেঞ্জি পরা দুই তরুণ দুই পায়ে পিঠ বরাবর একাধিকবার লাথি দেন। এ সময় পাশে থাকে কয়েকজন বলতে থাকেন, ‘দে দে, আরও দে।’ প্রদীপ লালকে দেখিয়ে আঙুল উঁচিয়ে একজন বলতে থাকেন, ‘এ ওইটাকও দে। মার। নড়ি পা** ঢুকি দেও’ বলে উল্লাস করতে থাকেন। এ কথা শুনে এক হলুদ গেঞ্জি পরা তরুণ গাছের ডাল দিয়ে আরও মারতে থাকেন। ছাইরঙা গেঞ্জি পরা এক যুবক রূপলালের মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলায় পা তুলে দেন। আশপাশের কেউ কেউ তখন বলছিলেন, ‘পুলিশ পালাইছে।’

এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মারধরে ১৫-২০ জন তরুণ-যুবক নেতৃত্ব দেন। প্রথমে পুলিশ সদস্যরা এলেও কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে ভয়ে চলে যান তারা। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি যখন আসে, ততক্ষণে ঘটনাস্থলেই রূপলাল মারা যান। ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন পালিয়ে যান।রূপলালের মামা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ দেখলো তারা মাত্র চার জন, ঘটনা সামাল দিতে পারছে না। বিষয়টি থানার ওসিকে কল করে জানালে আরও ফোর্স নিয়ে এলে হয়তোবা রূপলাল ও প্রবীর দাসকে জীবিত উদ্ধার করতে পারতো। কারণ পুলিশ আসা, অবস্থান করা ও চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পরও তারা দুজনই জীবিত ছিলেন।

পুলিশ জানায়, তাদের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে রোববার ভোর চারটায় তার মৃত্যু হয়।এ বিষয়ে নিহত রূপলালের ছেলে জানান, তার বাবা ভাগ্নি জামাই প্রদীপকে তার বড় বোন নুপুরের বিয়ের জন্য আসতে বলেছেন। তিনি নিজের ভ্যান চালিয়ে আসছিলেন। অনেক দিন পর আসছিলেন বলে রাস্তা চিনতে ভুল করেছিলেন। এরপর রূপলালকে কল করলে তিনি সেখানে গিয়ে দুজনে আসছিলেন। আর ব্যাগের ভেতরে থাকা তাড়ি (বাংলা মদ) তাদের সমাজে চলে, ফলে তাদের মব তৈরি করে চোর অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। এর বিপরীতে সেখানে চার জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তারা রূপলাল ও প্রদীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে যখন পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি, ঘুষাঘুষি শুরু করা হলে তখন তারা জীবনের ভয়ে সরে এসেছেন। পুলিশের করার কিছু ছিল না। এখন আমরা ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট শনিবার রাতে মুচি সম্প্রদায়ের রূপলাল ও তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপকে চোরের অপবাদ দিয়ে মব তৈরি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রূপ লালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে ৫০০/৭০০ অজ্ঞাতের বিরুদ্ধে তারাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ এ পর্যন্ত চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে।