যমুনার বুকে বিলীন হওয়া নিজের বাড়িঘরের স্থান দেখাচ্ছেন তোতা মিয়া।
‘না পারিলাম মরতে, না পারিলাম বাঁচিতে, না পারিলাম পিরিতের সোনার পাখি ধরতে।’ যমুনা নদীর গর্ভে বিলীন হওয়া নিজের বসতবাড়ির স্থান দেখিয়ে গানের কলিটুকু শোনালেন বৃ্দ্ধ তোতা মিয়া।
৬০ বছরের এ বৃদ্ধের আবাস বগুড়ার সারিয়াকান্দির কাজলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঘাগুয়া গ্রামে। সম্প্রতি যমুনা নদীর করাল গ্রাসে হারিয়েছেন নিজের ঘরসহ প্রায় ৫ বিঘার আবাদি জমি। শুধু তোতা মিয়ার নয়, গত দেড় সপ্তাহে গ্রামের আরও ১০ জনের ভিটেমাটি বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে।
গ্রামবাসীরা বলছেন, গত এক দশকে কাজলা ইউনিয়নের আট গ্রামের ভিটে-মাটি, ফসলী জমি, হাজারো মানুষের ঘটি-বাটি সবই চলে গেছে। এই সময়ে অন্তত ৩ কিলোমিটার এলাকা যমুনার গ্রাসে কাজলা ইউনিয়নের মানচিত্রটাই বদলে গেছে। এখন টিকে আছে চারভাগের মাত্র এক ভাগ।
এবার নিয়ে তোতা মিয়ার জীবনে নদী ভাঙ্গনের মুখে পড়েছেন তিনবার। অতীতে নদী ভাঙ্গনে তার প্রায় ১০ একর জমি বিলীন হয়েছে। সাজানো-গোছানো সংসার, স্বপ্ন সব ওলট পালট করে তাকে ছন্নছাড়া করেছে এই যমুনা। সব হারিয়ে এখন অন্যের জমিতে ঠাঁই নিয়েছেন মানুষটি।
তোতা মিয়া বলেন, ঈদের দুদিন আগে ভাঙ্গন ধরলো। যাইতে যাইতে সব ভাঙ্গছে। ঘাড়ের এই গামছাটি ছাড়া আর কিছু নাই বাবা। আমার আয় রোজগার করার সেই বয়স আর নেই। তিন জনের মধ্যে দু ছেলে খেটেখুটে কিছু আয় করে। সে দিয়েই সংসার চলে।
ভিটেমাটি হারিয়ে পাশের আনন্দবাজারে ঠাঁই নিয়েছেন মো. শুকুর প্রামানিকও। পানি নেমে গেলে আবাদি জমি ফিরে পাবেন। কিন্তু সাজানো বাড়িঘর আর ফিরে পাবেন না এই আফসোস চোখেমুখে তার।
আগে কেন সরে আসেননি এমন প্রশ্নে শুকুর প্রামানিক বলেন, মায়ায় পড়ে যেতে পারিনি। বাড়ির উঠানে আম-কাঠাঁলের গাছ, গোয়ালে ছিল গরু-ছাগল। সাজানো ঘর ভেঙ্গে উঠে যেতে কার মন চায়?
সম্প্রতি কাজলা ইউনিয়নে গেলে দেখা যায়, চর ঘাগুয়ার নদী পাড়ে বালু দিয়ে জিও ব্যাগ ভর্তি করার কাজ করছেন গ্রামের অন্তত পঞ্চাশ জন মানুষ। শনিবার থেকে জিও ব্যাগ ফেলে গ্রাম রক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। যদিও গ্রামের একটি পাড়া ইতিমধ্যে যমুনার পেটে চলে গিয়েছে। এখন যেটুকু গ্রাম টিকে আছে তার রক্ষায় লড়াই করছে স্থানীয়রা। ভাঙ্গন ঠেকাতে বালির বস্তা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাশে দাঁড়ালেও শঙ্কা কাটছে না যমুনার পাড়ের মানুষদের।
চর ঘাগুয়ার পাড়ে নামতেই নিশান নামে এক শ্রমিক বললেন, যাদের বাড়ি ভেঙ্গেছে তারা সবাই বাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। শনিবার থেকে জিও ব্যাগ ফেলছেন তারা। তবে কতটুকু রক্ষা পাবে তা নিয়ে সন্দেহ তাদের।
নদী ভেঙ্গে বৃদ্ধা মোছা. রেজিনা খাতুনের বাড়ির সন্নিকটে চলে এসেছে। কয়েকদিনের ভাঙ্গন দেখে তার মনে ভয় ধরে গেছে।
রেজিনা জানান, তার বয়সকালে তিন থেকে চারবার ভাঙ্গন দেখেছেন। কিন্তু এবার বেশি ভয় ধরিয়েছে। বৈশাখ মাস থেকে এবার নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। তখন থেকে চেষ্টা করলে এত মানুষের ঘরবাড়ি হারানো লাগতো না বলে মনে করেন তিনি।
পাশের চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের শিমুলতাইড় গ্রামে গেলে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রায় নদী গর্ভে চলে গেছে। এই এলাকার আশেপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। স্কুলটি বিলীন হলে গ্রামের ছেলেমেয়ের পড়ালেখা বিমুখ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
চর ঘাগুয়ার বাসিন্দারা জানান, প্রায় ১০ বছর আগে ভাঙনের শুরু সারিয়ান্দির কাজলা ইউনিয়নে। ভাঙ্গন মূলত শুরু হয় উজানের দিকের জামালপুর অংশের ইসলামপুর এলাকায়। এরপর বগুড়ার চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন ছুয়ে আঘাত হেনেছে কাজলা ইউনিয়নেও। এই ইউনিয়নের ট্যাকা মাগুড়িয়া, উত্তর ও দক্ষিণ বেনীপুর, কাজলা, কুড়িপাড়া, পাখিমারা, মিটনপাড়া ও ময়ুরের চরের সবটুকুই বিলীন যমুনার গর্ভে।
কয়েক বছরের নদীভাঙ্গনের কারণে কাজলা ইউনিয়নের সিংহভাগ মানুষের বসবাস চর ঘাগুয়ার গ্রামে। বর্তমানে গ্রামে প্রায় দুই হাজার পরিবারের ঘর রয়েছে। এতে অন্তত আট হাজার মানুষ বসবাস করছেন। বাকিরা সারিয়াকান্দির উপজেলা, শহরে বা জেলার বাইরে চলে গেছেন। গ্রামটিতে দুটি স্কুল, তিনটি মাদরাসা, একটি প্রতিবন্ধী স্কুল আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান মোল্লা বলেন, এখন যেখানে জিওব্যাগ ফেলে গ্রাম রক্ষা করা হচ্ছে নদী আগে এখানে ছিল না। অন্তত আরও তিন কিলোমিটার পশ্চিমে ছিল। ২০১৩ সাল থেকে একটু করে ভেঙ্গে আজকের এই জায়গায় এসেছে।
ভাঙ্গন শুরুর দেড় মাস পর বালির বস্তা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড হাজির হলেও সন্তুষ্ট নয় এলাকাবাসী। এতটা কাল নদীর বিরুপতাকে প্রকৃতির বিচার হিসেবে দেখে আসলেও এখন চরবাসীরা পরিবর্তন চান। তাদের দাবি, নদীর পাড়ে স্থায়ী কাজ করতে হবে। না হলে এই টাকা জলে যাবে।
স্থানীয় একটি মাদরাসার শিক্ষক সোহেল রানা বলেন, নদী ভাঙ্গনে কাজলা ইউনিয়নের চার ভাগের মাত্র এক ভাগ টিকে আছে। নদী শুধু পূর্ব পাশে প্রস্থ হচ্ছে। নদীর পাড় সিসিব্লক দিয়ে বাধাই করতে হবে। না করলে হয়তো এটিও থাকবে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আনিছ মোল্লা জানান, ঈদের আগে ভাঙ্গন শুরু হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ১০টি ঘর ভেঙ্গেছে। তারা সবাই বাজার এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। কাজলা এলাকায় ভাঙ্গনের জন্য নদীর নাব্যতাকে দায়ী করেন তিনি।
আনিছ মোল্লা বলেন, যমুনায় বালু জমায় পানির চাপ নদীর বাম তীরের গ্রামগুলোয় পড়ছে। কাজলার ভাটিতে জামালপুরের ইসলামপুর অংশে অনেক আগেই সংরক্ষণ হয়েছে যমুনার তীর। চর ঘাগুয়া থেকে উজানে মাত্র এক কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী কাজ হলে কাজলার পাশাপাশি চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নও ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতার কামনা করেন ইউপি সদস্য আনিছ মোল্লা।
নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করছেন বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। দপ্তরটির নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, চর ঘাগুয়াসহ আশেপাশের কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পিপি ও ননপিপি ব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা চলছে। নাব্যতা সংকট নিরসনে যমুনা নদীর মূল অংশে খননের বিকল্প নেই। এ জন্য আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছি। আর ডানতীরের মতো বামতীরের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ব্লক ফেলে বাঁধ দিলে ভাঙ্গন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
গত সোমবার দুপুরের পাউবোর তথ্য অনুযায়ী যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার এক দশমিক ১৩ মিটার নিচে রয়েছে। আর বাঙালী নদীর পানি রয়েছে বিপৎসীমার ২ দশমিক ২৬ মিটার নিচে। তবে আগামী এক সপ্তাহ পর যমুনার পানি বৃদ্ধি পেতে পারে।