Joy Jugantor | online newspaper

নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প 

বগুড়ায় ৫ মাসে স্ট্যাম্প বিক্রিতে অবৈধ আদায় দেড় কোটি! 

আব্দুল আউয়াল

প্রকাশিত: ২০:২৫, ৩০ জুন ২০২২

আপডেট: ২০:০৭, ১৩ আগস্ট ২০২২

বগুড়ায় ৫ মাসে স্ট্যাম্প বিক্রিতে অবৈধ আদায় দেড় কোটি! 

বগুড়া ডিসি অফিস চত্বরে স্ট্যাম্প ভেন্ডার।

একশ টাকার স্ট্যাম্প কিনতে গেলে দাম দিতে হচ্ছে ১১০ টাকা। কেউ কেউ আবার নিচ্ছেন ১২০ টাকাও। ৫০ টাকার স্ট্যাম্পের জন্য গুণতে হচ্ছে ৫৫। পাঁচ টাকার স্ট্যাম্পের জন্য বাড়তি আরও এক টাকা লাগে। ১০ টাকার স্ট্যাম্পের দাম নেয়া হচ্ছে ১২ টাকা। ২০ টাকার স্ট্যাম্পের প্রয়োজন হলে বাড়তি আরও ৫ টাকা দিতে হবে। 

বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর এমনকি জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ভেন্ডাররা এভাবেই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে স্ট্যাম্প বিক্রি করছেন ভেন্ডাররা। সাধারণ মানুষকেও বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দামেই কিনতে হচ্ছে স্ট্যাম্প। 

অতিরিক্ত দাম নেয়ার পেছনে অবশ্য নানান যুক্তি খাড়া করছেন ভেন্ডাররা। তাদের দাবি, চাহিদা অনুযায়ী স্ট্যাম্পের সরবরাহ না থাকায় এবং সরকার নির্ধারিত মুনাফা কম হওয়ার কারণে দাম বেশি রাখছেন তারা। 

দলিল নিবন্ধন, চুক্তিপত্র, নোটারি পাবলিক কার্যালয়ে এফিডেভিট, হলফনামা, বন্ধকনামার চুক্তিপত্র, মালামাল খালাস আদেশ, শুল্ক বন্ড, শেয়ার বরাদ্দ, মামলা মোকদ্দমাসহ বিভিন্ন কাজে স্ট্যাম্প ব্যবহার বাধ্যতামুলক। সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ থাকলেও এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অতিরিক্ত দামে স্ট্যাম্প বিক্রি করছেন স্ট্যাম্প ব্যবসায়ী ও ভেন্ডাররা। যার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। 

সদরের বাসিন্দা আলমাছ আলী একজন কৃষক। দলিল নিবন্ধনের জন্য ১০০ টাকার দুইটি স্ট্যাম্প কিনতে সম্প্রতি এসেছিলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। তিনি জানান, ১০০ টাকা করে ২০০ টাকার স্ট্যাম্পে তার অতিরিক্ত ৩০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। বাড়তি ৩০ টাকা তার মতো গরীব কৃষকের কাছে একবেলা ভাতের টাকা- বলেন, আলমাছ।

ইদ্রিস শেখের সাথে কথা হয় জজকোর্ট প্রাঙ্গণে। তিনি এসেছেন ৫০ টাকার একটি স্ট্যাম্প কিনতে। ৫৫ টাকায় সেই স্ট্যাম্প কিনেছেন তিনি। তার অভিযোগ, ৫ টাকা হয়তো খুব বেশি টাকা নয়; তবে এভাবে ৫০০ মানুষের কাছে থেকে দিনে বেশি নেওয়া মানে পুকুর চুরির সমান। স্ট্যাম্পের দাম নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান না হলে এক শ্রেণির মানুষ জনসাধারণের পকেট কাটতে থাকবে। 

তবে দাম বাড়ার পেছনে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন স্ট্যাম্প ব্যবসায়ী ও ভেন্ডাররা। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত মুনাফা কম ও চাহিদা অনুযায়ী স্ট্যাম্প সরবারহ না থাকায় এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের প্রতি চালান স্ট্যাম্প ক্রয়ের সময় ভ্যাট ও আয়কর দিতে হয় ২৫ শতাংশ।  এতে করে তাদের মুনাফা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। 

বগুড়া জেলা ভেন্ডার মালিক সমিতির একটি সূত্র জানায়, জেলায় ১২ উপজেলায় সরকারিভাবে লাইসেন্স নিয়ে প্রায় ৩০০ জন ভেন্ডার ব্যবসায়ী স্ট্যাম্প বিক্রি করেন। এর মধ্যে বগুড়া শহরে ডিসি অফিস চত্বরে ২৫ জন ও জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে ২৮ জন ভেন্ডার স্ট্যাম্প বিক্রি করেন। বাকি ১১ উপজেলার সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এই স্ট্যাম্প বিক্রি হয়। 

ভেন্ডার ব্যবসায় লাইসেন্স পাওয়া ব্যবসায়ীদের বগুড়া জেলা ট্রেজারি শাখায় টাকা জমা দিতে হয়। সপ্তাহে দুদিন রোববার ও বুধবার এই টাকা জমা নেওয়া হয়। পাশাপাশি এই দুইদিনেই ট্রেজারি শাখা জমা নেওয়া টাকার বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী স্ট্যাম্প সরবারহ করে থাকে। রোববারে জমা নেওয়া টাকার স্ট্যাম্প সরবারহ করা হয় বুধবারে। আর বুধবারে জমা নেওয়া টাকার স্ট্যাম্প ভেন্ডার ব্যবসায়ীরা পরের সপ্তাহের রোববারে। 

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ভেন্ডার ব্যবসায়ীরা প্রতি চালানে শতকরা দেড় থেকে দুই শতাংশ লাভ পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে সদর উপজেলার লাইসেন্স পাওয়া ব্যবসায়ীরা লাভ পান দেড় শতাংশ ও বাহিরের উপজেলার ব্যবসায়ীরা লাভ পেয়ে থাকেন দুই শতাংশ করে। 

সমিতি সূত্র জানায়, চালানের ৯৮ শতাংশ অর্থ স্ট্যাম্প ক্রয়ের জন্য জমা দিতে হয়। এরপর সরবারহের সময় সরকার নির্ধারিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ আয়কর পরিশোধ করার পর স্ট্যাম্প হাতে পান ব্যবসায়ীরা। 

এছাড়াও এই সমিতির অভিযোগ প্রতি চালানে বগুড়া জেলা ট্রেজারি শাখায় তাদের ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে ঘুষ দিতে হয় বলে একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ‘ঘুষ ও ভ্যাট-ট্যাক্সের’ ফলে গড় হিসেবে তাদের গায়ের দামেই স্ট্যাম্প কিনতে হয়। ফলে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত দামে স্ট্যাম্প বিক্রি করছেন তারা। 

ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, বগুড়ায় স্ট্যাম্পের চাহিদা ব্যাপক। তবে প্রায় সময়ই চাহিদা অনুযায়ী ট্রেজারি শাখা স্ট্যাম্প সরবারহ করতে পারে না। এতে ভেন্ডারে স্ট্যাম্প সংকট দেখা দেয়। ফলে প্রায় সময় ব্যবসায়ীরা প্রতিবেশী বিভিন্ন জেলা থেকে গায়ে নির্ধারিত দামে স্ট্যাম্প ক্রয় করেন। এছাড়াও যাতায়াত ভাড়া ও অন্যান খরচসহ স্ট্যাম্পের দাম গায়ে নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি পড়ে যায়। এ জন্য ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দামে ভেন্ডারে স্ট্যাম্প বিক্রি করে থাকেন। 

ভেন্ডার ব্যবসায়ীরাও বাড়তি দামের কথা স্বীকার করছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা অন্তত ১০ শতাংশ বেশি দামে স্ট্যাম্প বিক্রি করেন। 

বগুড়া জেলা ট্রেজারি শাখা সূত্রে জানায়, জেলায় চলতি বছরে জানুযারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৪৫০ টাকার স্ট্যাম্প বিক্রি হয়েছে। ১০ শতাংশ করে বেশি টাকা নেয়া হলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্তত ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাড়তি নেয়া হচ্ছে। বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা। 

সংকটের অজুহাত দেখিয়ে বেশি টাকা নেয়া হলেও ট্রেজারি শাখা বলছে, সাধারণত বগুড়ায় নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সরবারহে সংকট নেই। তবে বিশেষ পরিস্থিতি হলে আলাদা বিষয়। 

আতিকুর রহমান জজ কোর্ট এলাকায় ১৪ বছর ধরে স্ট্যাম্প বিক্রি করেন। অতিরিক্ত দামে স্টাম্প বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের স্বল্প মুনাফা নীতি ও সরবরাহ সংকটের কারণে এমন হয়।’

তিনি বলেন, ‘সবকিছু শেষে ২৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। পাশাপাশি ট্রেজারি অফিসে অতিরিক্ত কিছু অর্থও দিতে হয়। এরপর আমাদের আর কোন মুনাফা থাকে না।’ 

ডিসি অফিসের সাবেক কর্মচারী আব্দুর রহমানের বয়স ৬৫ পার হয়েছে। অবসরে যাওয়া পর দুই বছর ধরে ডিসি অফিস চত্বরেই ভেন্ডারের দোকান দিয়েছেন তিনি। স্ট্যাম্পে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার কথা স্বীকার করলেন তিনিও। 

আব্দুর রহমান বলেন, ‘বাধ্য হয়ে আমাদের ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি নিতে হয়। তাছাড়া বাপু আমাদের তো কিছু থাকে না।’ 
জানতে চাইলে বগুড়া জেলা ভেন্ডার সমিতির সভাপতি আলতাব হোসেন জনান, ‘সরবারহ ঠিক থাকলে ও আমাদের মুনাফা কিছুটা বাড়িয়ে দিলে আমরাও অতিরিক্ত দাম আদায় করব না।’

তবে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলছেন, ‘বেশি দামে স্টাম্প বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ বেশি দামে স্টাম্প বিক্রি করলে খোঁজ-খবর তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’