
আবু সালেহ স্বপন
ছয় বছরেও শেষ হয়নি বগুড়ার ধুনট উপজেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন। সংগঠনের নীতি বিরুদ্ধ হলেও বিবাহিত সাধারণ সম্পাদক দিয়েই চলছে পুরোনো কমিটির কার্যক্রম। এই নেতার বিরুদ্ধে কলেজছাত্রীকে অপহরণ, কমিটি বানিজ্য, সাধারণ মানুষকে মারধরসহ উঠেছে নানা অভিযোগ রয়েছে।
ধুনট উপজেলা ছাত্রলীগের এই নেতার নাম আবু সালেহ স্বপন। তিনি ধুনট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
সংগঠনে পদ দেওয়ার নাম করে চলতি বছরের ১১ মার্চ সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে অর্থ নেয়ার অভিযোগ করেন উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের চার পদবঞ্চিত ছাত্রনেতা। এমন অভিযোগ লিখিতভাবে জেলা ছাত্রলীগের কাছে করেছেন তারা। এতে ওই ছাত্রনেতাদের বিভিন্ন হুমকি, ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। অভিযোগ দিয়ে ওই চার নেতাই এখন এলাকা ছাড়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালে কালেরপাড়া ইউনিয়নে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের গত ২২ ফেব্রুয়ারি কালেরপাড়ায় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কর্মী সম্মেলন হয়। পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি কালেরপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কমিটির তালিকা প্রকাশ হয়।
উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ স্বপন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এই তালিকা পোস্ট করেন। এ ছাড়াও উপজেলার আরও কয়েকটি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কমিটির তালিকা সেদিন প্রকাশ করেন আবু সালেহ।
তালিকা প্রকাশের পরপরই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রনেতাদের মধ্যে। এ সময় আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি বের হয়ে আসে। ক্ষুব্ধ ছাত্রনেতারা অভিযোগ করেন, কমিটি গঠনের কোনো কিছু আগে থেকে জানানো হয়নি। নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কখনও ইউনিয়নে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্তি ছিলেন না। আবু সালেহ স্বপন টাকার বিনিময়ে গোপনে পকেট কমিটি গঠন করেছে। আর এসব বিষয় নিয়ে যখন পদবঞ্চিতরা বিভিন্ন জনের কাছে জানানোর চেষ্টা করেন, তখন তাদের হুমকি দেয়া শুরু হয়।
কালেরপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন আতিকুর রহমান। তিনি জানান, সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য আমার কাছে ৪৫ হাজার টাকা দাবি করেন আবু সালেহ স্বপন। এর আগে আরেক জনের কাছে থেকে ওই পরিমাণ টাকা নিয়েছেন তিনি। আমি গরু বেচে সেই টাকা যোগাড় করে দিয়েছি। কিন্তু পরে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি নেওয়াজ শরীফ নামে একজনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। অথচ এই নেওয়াজ শরীফকে কেউ ছাত্র রাজনীতি করতে দেখেননি।
কাওসার আহম্মেদ নামে আরেক সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমার কাছেও টাকা দাবি করেছিল। কিন্তু আমি টাকা দিয়ে পদ নিব না বলেছিলাম। তখন আবু সালেহ স্বপন আমাকে বলেছিলেন, টাকা ছাড়া কোনো পদ হয় না। বুঝিস তো এগুলোতে অনেক খরচ।
কাওসার আরও বলেন, পরে টাকা নিয়ে কমিটি গঠনের বিষয়ে অভিযোগ দেয়ার পর থেকে স্বপন আমাদের হুমকি দিতে থাকেন। বিভিন্ন লোক মারফত আমাদের কাছে খবর দেয়, এটা নিয়ে যেন বেশি কথা না বলি। এখন তার ভয়ে আমরা বাড়িতেও থাকছি না।
কালেরপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন তানভির আহম্মেদ সরকার। তার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তানভির বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি কর্মী সম্মেলন হওয়ার পর আমাদের কাছে সিভি নেয়া হয়। এরপর স্বপন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি খরচের কথা জানান। তখন বড় ভাই হিসেবে অর্থ চাওয়ায় তাকে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আরও টাকা চান। তখন আমি এর বেশি টাকা দিতে অপরাগতা জানাই। আর ওই টাকা ফেরত চাইলে তিনি ২৪ ফেব্রুয়ারি টাকা ফেরত দিয়ে দেন। এরপর তো দেখি ২৭ ফেব্রুয়ারি কমিটি ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে।
তানভির বলেন, অভিযোগ দিয়ে আমরাই এখন প্রাণনাশের ভয়ে আছি। এ জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকছি। কারণ স্বপন বা তার লোকজন আমাদের সামনে পেলে ক্ষতি করবে। আমরা তো নৌকার জন্য রাজনীতি করি। কোনো দলাদলি বা টাকা দিয়ে পদবানিজ্য করতে চাইনি। আমাদের দাবি, স্বপনের বিরুদ্ধে তদন্ত করুক। তদন্ত করলেই ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসবে। তখন সাংগঠনিকভাবে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
কালের পাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মাসুম তরফদার বলেন, কমিটি হয়েছে, কিন্তু আমাকে কিছু জানানো হয়নি। এখনও কমিটি আমার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তবে পদের জন্য টাকা নেয়ার যে অভিযোগ উঠছে, তা সত্যি নয়। আসলে পদবঞ্চিত হলে তারা এমন অভিযোগ করেই। আর এই অভিযোগকারীরা আসলে অন্য আরেকজনের রাজনীতি করে, যে আমাদের ধারার নয়।
বগুড়ার ধুনট উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন হয় ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে ওই কমিটি বহাল আছে। এর মধ্যে আবু সালেহ স্বপন গত বছর আগস্টে বিয়ে করেন এক কলেজ ছাত্রীকে। বিবাহিত হওয়ার প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি স্বপদে রয়েছেন।
ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, আবু সালেহ স্বপন আগে ধুনট-শেরপুরের স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগের কারণে সংসদ সদস্য স্বপনকে বিতাড়িত করেন। পরে স্বপন যোগ দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনুর অনুসারীদের সাথে।
উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে সম্প্রতি আরেকটি পরিবর্তন আসে। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি পদ দেওয়ার নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বগুড়ার ধুনট উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকারিয়া খন্দকারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর রফিকুল ইসলাম মঞ্জু ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
জাকারিয়া খন্দকার বলেন, আমাকে মূলত গ্রুপিং করে সরানো হয়েছে। তারা বলে আমাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে, আমি সন্তোষজনক জবাব দেয়নি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি কোনো নোটিশ পাইনি। অথচ এই আবু সালেহ স্বপনের বিরুদ্ধে সরকারি গাছ কাটা, অপহরণ, সাধারণ মানুষকে মারধর করার একাধিক অভিযোগ আছে। যাকে অপহরণে মামলা হয়েছিল, পরে তো সেই মেয়েকেই বিয়ে করেন স্বপন।
স্বপনের বিরুদ্ধে পদ বানিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কমিটির নামে টাকা নেয়ার কথা আমিও শুনেছি। এগুলো নিয়ে ফেসবুকে লাইভও করেছে অভিযোগকারীরা। ধরে নিলাম আমি টাকা আত্মসাৎ করেছি। তাহলে এখন স্বপন যে টাকার বিনিময়ে কমিটি দিচ্ছেন, তার কি হবে? আবার বিয়ে করেও ছাত্রলীগের পদে আছে। এখন কেন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ স্বপন বলেন, আমি উপজেলা ছাত্রলীগে সাংগঠনিকভাবে পূর্নগঠনে কাজ করছি। যারা কখনও ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত নয়, তারাই তৃতীয় কারো দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে আমার সম্মানহানীর জন্য এই কাজ করছে।
বিবাহিত হওয়ার পরেও ছাত্রলীগের দায়িত্বে স্বপনের থাকার কারণ সম্পর্কে জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কিছু বলতে পারেননি। তবে দ্রুত নতুন কমিটি দেয়ার কথা জানান তারা।
পদবঞ্চিতদের অভিযোগ নিয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহিদুল ইসলাম জয় বলেন, এ বিষয়ে আমরা মৌখিক অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু আমাদের কাছে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি তারা।
সংগঠনটির জেলা সভাপতি সজিব সাহাও অভিযোগ প্রাপ্তি বিষয়টি অস্বীকার করেন। আর আবু সালেহ স্বপনের বিষয়ে তিনি বলেন, স্বপন বিবাহিত ঠিক আছে। কিন্তু এখন ইউনিয়ন কমিটিগুলো দেয়া হচ্ছে। এগুলো শেষ হলেই উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হবে।