Joy Jugantor | online newspaper

করতোয়ার উন্নয়ন প্রকল্প

২২ বছরে ব্যয় বৃদ্ধি ২২ গুণ

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ১২ মে ২০২৩

আপডেট: ১৯:২৪, ১৩ মে ২০২৩

২২ বছরে ব্যয় বৃদ্ধি ২২ গুণ

বগুড়া শহরের চেলোপাড়া ফতেহ আলী ব্রিজ।

বগুড়ার শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় করতোয়া নদীর উন্নয়নে ১৩২ কোটির প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০০১ সালে। এরপর কেটে গেছে প্রায় ২২ বছর। এই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নদীটির প্রাণ ফেরানোর প্রকল্পের ব্যয়ও। এখন  এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২২ গুণ। তবে ২২ বছরেও এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। সমীক্ষার অপেক্ষায় আটকা করতোয়ার ভাগ্য। 

ফলে গেল দুই দশকে করতোয়ার ভাগ্য ফেরার বদলে বরং মৃত্যু হয়েছে। উন্নয়নের নামে সরকারি খরচের খাতাকে ভারি করা হয়েছে। ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়ার ফলে ক্ষমতাবানদের পেট মোটা হবে বলে অভিমত বগুড়ার পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদের। 

দখল-দূষণে মৃত করতোয়া নদীর সর্বশেষ প্রকল্পের প্রস্তাবনা ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। নাম দেয়া হয়েছে ‘স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’। 

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, করতোয়া নদী উন্নয়নের প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘সবুজ পাতায়’ আছে। সমীক্ষায় সব কিছু ঠিক থাকলে করতোয়া প্রকল্প ত্বরান্বিত হতে আর কোনো বিপত্তি থাকবে না। 

দেশের প্রাচীন ও দীর্ঘতম নদী করতোয়ার উৎস ভারতের জলপাইগুড়িতে। প্রায় ২০০ বছর আগে করতোয়া নদীতে বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। তখন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে দেখা দেয় তীব্র ভাঙন। সেখানে কাটাখালির দিকে সৃষ্টি হয় নতুন প্রবাহ। এ থেকে দুইভাগে ভাগে বিভক্ত হয় করতোয়া। কাটাখালি হয়ে একটি প্রবাহ গিয়ে মিশে যায় বাঙালি নদীতে। আরেকটি করতোয়ার মূল ধারা। এই মূল ধারাই বগুড়া হয়ে সিরাজগঞ্জের হুরাসাগর নদীতে পড়েছে।
করতোয়া নদীর বগুড়ার শিবগঞ্জের উত্তরের সীমানা থেকে শেরপুরের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত মোট ১২৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কাজ হবে উন্নয়ন প্রকল্পের।  

পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে করতোয়া নদীর উন্নয়নে প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময় করতোয়া নদীর দূষণ ঠেকাতে এবং পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রেখে শহরটির সৌন্দর্যবর্ধনের মূল লক্ষ্য ছিল। প্রথম ধাপে ২০০২ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে করতোয়া নদীর চেলোপাড়া থেকে নাটাইপাড়া অংশে তীর সংরক্ষণ করে মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ হয়েছিল। সেখানে গাছ ও রোড লাইট স্থাপন হয়। এরপর সেখানেই কাজের সমাপ্তি। 

পরবর্তীতে ২০০৬ সালে করতোয়াকে নিয়ে আবার প্রকল্প ১৩৬ কোটি টাকার প্রস্তাবনা দেয়া হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও পৌরসভা যৌথ ভাবে করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়।
১৩৬ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে করতোয়া নদীর পূর্ব তীরে ১০ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং পশ্চিম তীরে ৯ দশমিক ১৭ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সাড়ে ৪৭ কিলোমিটার করতোয়া নদী পুনঃখনন, নদীর বিভিন্ন বাঁকে পানিপ্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, এ জন্য নদী সোজা করতে এক কিলোমিটার খনন, শহরতলীর মাদলা এলাকায় একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ, নদীর ঢালে সাড়ে তিন কিলোমিটার সিসি ব্লক, সাড়ে তিন কিলোমিটার ঢাল উন্নয়ন, শহরের দুটি স্থানে দুটি নান্দনিক ঘাট নির্মাণ, নদীর পানি কাজে লাগাতে চারটি জলকপাট (স্লুইচগেট) নির্মাণ, করতোয়া-সংলগ্ন সুবিল খালে ছয়টি বক্স কালভার্ট এবং ৪০০টি খুঁটি নির্মাণ করার প্রস্তাব রয়েছে।

দুই বছরের সমীক্ষা শেষে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মহাজোটের আমলে প্রকল্প প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এরপর এর আর কোনো খবর জানা যায়নি।

কয়েক বছর পর ২০১১ সালে করতোয়াকে বাঁচাতে ফের তোড়জোড় শুরু হয়। করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প শিরোনামে নতুন করে উদ্যোগ নেয় পাউবো। তবে সেসব ছিল খণ্ডিত প্রকল্প। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে  পূর্ণাঙ্গভাবে  প্রকল্প প্রস্তাবনা দেন তৎকালীন বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ। এতে করতোয়াসহ বগুড়ার গজারিয়া, ইছামতি নদী সংস্কারে ২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। তবে গোবিন্দগঞ্জের খুলসি থেকে বগুড়ার শেরপুর পর্যন্ত করতোয়ার ১১৯ কিলোমিটার নদী উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল পৌনে ১২শ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে যায়। এবং তখন থেকেই কমিশনেই ফাইল চাপা হয়ে পড়ে আছে। 

এই প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৪২ কোটি। তবে এই টাকার অংকটি খরচ হবে শুধু করতোয়া নদীতে।

এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে করতোয়া নদীর পরিবেশ দূষণ বন্ধ, শহরের যানজট নিরসনে সড়ক নির্মাণ। করতোয়া নদীর বগুড়া জেলা অংশের শিবগঞ্জ উপজেলার উত্তরের সীমানা থেকে শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত মোট ১২৩ কিলোমিটার এলাকা খনন। 

একই সঙ্গে খনন করা হবে সুবিল খাল ৩১ কিলোমিটার, ইছামতী নদী ও গজারিয়া খালের ৭৫ কিলোমিটার। নদীর দুই পাড়ের ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা ও ৬ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ, মাস্টার ড্রেন নির্মাণকাজ, পানি নিয়ন্ত্রণে তিনটি অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর দুই পাড়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, পানির ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণকাজ। প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণ থাকবে। 

এসব উন্নয়নকাজ জনগণের স্বার্থে হওয়া উচিত। দীর্ঘ বছর পর প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে করতোয়া নদী রক্ষায় কতখানি ফলপ্রসু হবে এমন প্রশ্ন রাখেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বগুড়ার জেলা সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন। 

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যে মেগা প্রকল্প মানে মেগা চুরি। এত বড় ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখানে অবশ্যই রাষ্ট্রের নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করি।

সুজনের সম্পাদক আরও বলেন, গত ২০ থেকে ২২ বছরে করতোয়া নদীর ছোট্ট ঘা প্রকট আকারের পরিণত হয়েছে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে সেখানে ভুক্তভোগী হতে হয় নাগরিকদের। 

পাউবোর বগুড়া জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক জানান, করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্পের সমীক্ষা যাচাই চলছে। ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেল (আইডব্লিউএম), বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিবিএস) ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যৌথভাবে এই সমীক্ষা করছে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সমীক্ষা শেষ হওয়ার কথা। 

নাজমুল হক আরও বলেন, করতোয়া নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলছে। তবে ২০১৯ সালের পর এটি বেশি জোরদার হয়। এ প্রকল্পটির সমীক্ষা করছে তিন প্রতিষ্ঠান। এখানে সুখবর হচ্ছে প্রস্তাবনাটি একনেকের সবুজ পাতাভুক্ত হয়ে আছে। মানে প্রথম ধাপ সম্পন্ন। সমীক্ষায় কমপোনেন্টগুলো (উপাদান) যাচাই শেষ হলে প্রকল্পটি পাশ হয়ে যাবে। 
গোবিন্দগঞ্জের খুলসি পয়েন্ট।

এক সময়ের খরস্রোতা করতোয়া নদীকে হত্যার প্রক্রিয়া বেশি দিনের নয়। তিন দশক আগেও নদীর যৌবন ছিল। আশির দশকে এখানেই স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তারপর থেকেই বিপন্ন হতে থাকে করতোয়ার অস্তিত্ব। প্রবাহ না থাকায় করতোয়াকে ঘিরে শুরু হয় দখল-দূষণের উৎসব।

এখন খুলসি পয়েন্টে গেলে কেউ না বলে দিলে করতোয়া নদী চেনা খুব কঠিন। ফসলের মাঠ আর সড়কের মাঝে হালকা ঢালকে ড্রেন ছাড়া কিছুই মনে হয় না।

এই স্লুইস গেটটি নতুন প্রকল্পে থাকবে। তবে পাউবো কর্মকর্তাদের মতে, গেটটি কিছুটা প্রসারিত হবে নতুন প্রকল্পে। এখন আছে তিন দরজা। সেটি বড় আকারে চারটি দরজায় ভাগ করা হবে।

তবে মৃত্যু প্রক্রিয়ায় শুধু এই স্লুইস গেট দায়ী নয়। হত্যাযজ্ঞে সমভাবে দায়ী দখল ও দূষণকারী। একদিকে নদীর পানি প্রবাহ কমেছে। অন্যদিকে মানুষ নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে, নদীর বুক ভরাট করে দখল করেছে।  

গোবিন্দগঞ্জের খুলসির দক্ষিণে কাটাখালি ব্রিজের নিচে যেমন হয়েছে ভাগাড়। একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে বগুড়ার অংশে বিভিন্ন বন্দর ও বাজার এলাকায়। অথচ ২০১৫ সালে উচ্চ আদালত নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

এ ছাড়া বগুড়া জেলা প্রশাসন আদালতের নির্দেশে করতোয়া নদীতে ৩৮ অবৈধ দখলদারের তালিকা তৈরি করে। তালিকাভুক্ত দখলকারীদের অনেককে উচ্ছেদ করা হলেও দুই দখলদার টিএমএসএস ও বিসিএল থেকে যায় বহাল তবিয়তে। করতোয়ার বুকে এই দুই দখলদারের আঘাত হানা এখনও চলমান আছে। সম্প্রতি নদীর মাঝে মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণের দায়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু তারা জরিমানা না দেয়ায় নিয়মিত মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে।  

এ বছরের ২ মে বগুড়ার সার্কিট হাউজে এক কর্মশালা হয়। সেখানে বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, করতোয়া নদী বগুড়ার প্রাণ। কিন্তু দখল-দূষণে করতোয়া নদীর প্রাণবৈচিত্র্য প্রায় নিঃশেষ। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে এই অংশটি ওয়াকওয়ে করে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আমরা আশাবাদী করতোয়া আবার প্রাণ ফিরে পাবে।

একই দিন সেখানে উপস্থিত পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, করতোয়া নদীকে বাঁচাতে আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব, তার সবটুকুই করা হবে। এবার প্রকল্পটি পাশে দেরি হবে না আশা করা যাচ্ছে।