
বগুড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসের ভিতরে
বগুড়া ফায়ার সার্ভিস অফিসের ভিতরেই ছিল একটি পুকুর। বছর পাঁচেক আগে ভরাট হয়েছে। ভরাট হওয়ার ঘটনাও অদ্ভুত। খোদ ফায়ার সার্ভিসের বর্জ্যেই তার অস্তিত্ব বিলীন প্রায়। এখন ওই পুকুরের শুধু অবয়ব আছে। অথচ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের অগ্নিনির্বাপনের জন্য পানি সংগ্রহের জন্য পুকুরটি বেশ জরুরি ছিল।
বগুড়ায় এমন জরুরি অনেক পুকুর ছিল তার অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বগুড়া শহরে পুকুরের একটি তালিকা করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে এমন কিছু পুকুরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। অনেক এলাকায় পুকুর রয়েছে; সেখানে আবার পানি নেই।
অথচ ইচ্ছে করলেই জলাধার ভরাট করা যায় না, এমন আইন আছে দেশে। শুধু তাই নয়, লোকালয়ের পরিবেশগত ভারসাম্য রাখতেও সাহায্য করে এই পুকুর, ডোবাসহ বিভিন্ন জলাশয়। তার তোয়াক্কাও কেউ করছে না।
সম্প্রতি রাজধানীর বড় দুটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সব ধরনের মানুষের মনে নির্বাপন ব্যবস্থা নিয়ে নাড়া দিচ্ছে। কিন্তু আগুন নেভানোর সবচেয়ে সহজলভ্য ব্যবস্থা পানিই বগুড়া শহরে দুর্লভ্য হয়ে উঠছে। এমনকি ঢাকার বঙ্গবাজারের পর বগুড়ার সবচেয়ে জনবহুল নিউ মার্কেটে আগুন লেগেছিল। গত শনিবার আগুন ধরে নিউমার্কেটের পাশের চুড়িপট্টিতে। তবে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
বগুড়ার প্রবীন বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বিগত ১০ বছরে এভাবেই ভরাট হয়ে গেছে বগুড়ার অর্ধশতাধিক পুকুর-জলাশয়।
বগুড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স প্রতি উপজেলায় অগ্নিনির্বাপনে সুবিধার জন্য জলাধারের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকায় পানির উৎস হিসেবে শহরের মাঝবরাবর বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর নাম উল্লেখ করা আছে। কিন্তু দখল দূষণে বহুদিন আগেই নদীটি মৃতপ্রায়। আগুন লাগলে সেখান থেকে পানি নেওয়ার তেমন উপায় নেই।
২০১৮ সালের তালিকায় শহরে পুকুরের সংখ্যা ছিল ৯২টি। ২০১৯ সালে ৭৭ টি। তারপরের বছরও তালিকায় বগুড়া শহরে ৭৭টি পুকুরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর আর নতুন কোনো তালিকা তৈরি হয়নি। ২০২০ সালের তালিকা অনুযায়ী অনেক পুকুরের এখন আর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ মতে, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
জেলা ফায়ার সার্ভিসের তালিকা থাকা শহরের কলোনী এলাকায় তিনটি পুকুরের কথা হয়েছে। এগুলোর পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২০, ৬০ ও ৪০ শতক। কিন্তু সরেজমিনে এ রকম কোনো পুকুরের খোঁজ কলোনীতে পাওয়া যায়নি। ওই এলাকায় রশিদ মণ্ডলের বাড়ির ভিতরে প্রায় ১৫ শতকের একটি পুকুর ছিল। এ পুকুর অন্তত ৫ বছর আগে বিভিন্ন বর্জ্যে ভরাট হয়েছে। পুকুরের পাড়ে ভবন নির্মাণের সময় পুকুরটির প্রায় অর্ধেক অংশই ভরাট হয়ে যায়।
ফুলদীঘি এলাকায় ছয়টি পুকুরের কথা উল্লেখ আছে তালিকায়। পুকুরগুলোর অস্তিত্ব আছে। তবে দুটিতে এখন পানি নেই। বনানী রেশম বাগানে একটি পুকুরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
শহরের মাতলতিনগরের ভাটকান্দি ব্রিজ সড়কের সাহেববাজার এলাকায় সাড়ে সাত বিঘার একটি পুকুর ছিল। মাটি দিয়ে ভরাট করে পুকুরের জমি বিক্রি করে প্রায় তিন বিঘার মতো কমে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় এই পুকুরের নাম নেই।
শহরের সেউজগাড়ী এলাকায় চারটি পুকুরের কথা বলা হয়েছে। এসব পুকুর এখন যে চিত্র দেখা যায় সেটিও ভরাট পরবর্তী চেহারা। কামারগাড়িতে পুকুর আছে। তবে মুন্নুজান হলের সাথে থাকা পুকুরটি লতাপাতা-জঙ্গলে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এর ঠিক পূর্ব পাশে রেলের আওতাধীন দুটি ছোট পুকুরে মাছচাষ হয়। কিন্তু শুকনো মৌসুম হওয়ায় পানি একেবারে পুকুরের তলায়।
রহমাননগরে একটাই পুকুর, বগুড়া সড়ক ও জনপদ বিভাগের (সওজ) মধ্যে। এটি আগে ছিল প্রায় আড়াই বিঘা আয়তনের। এখন ১৫ শতকে দাঁড়িয়েছে। পুকুর ভরাট করে ফুলের বাগান ও মসজিদ করেছে বগুড়া সওজ।
শহরের ঝাউতলা এলাকা ও আশপাশে বিভিন্ন রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মতে এই এলাকা খুব ‘ভয়ঙ্কর’। ঝাউতলা এলাকার এই পুকুরের মালিক তারা মিয়া। এই পুকুরের পশ্চিম দিকের অংশ ভরাট করে বাড়ি করা হয়েছে। বাকি অংশে যৎসামান্য পানি আছে।
জেলা ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নিনির্বাপনের জন্য মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করেন তারা। কিন্তু বড় আকারের অগ্নিকাণ্ডে এই পানি পর্যাপ্ত নয়। সেক্ষেত্রে পুকুর বা যেকোনো জলাধার থেকে অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা হতে পারে। এই কারণে সংস্থাটি পুকুরের তালিকা তৈরি করা।
এই তালিকা ও তালিকার বাইরে থাকা বগুড়া শহরের ১৫ টি পুকুর ঘুরে ভরাটের বিভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। শহরের মালতিনগরের স্টাফ কোয়ার্টারের পুকুর ভরাট হয়েছে বছর দশেক হলো। পুকুরের তলা দুর্বা ঘাস জন্মেছে। জঙ্গলে ভরে রয়েছে চারপাশ। স্থানীয়রা বলছেন, কেউ খোঁজ নেয়না বলে এমন হয়েছে।
মালতিনগরের পাশেই চকমালগ্রাম এলাকা। মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল কুদ্দুস পাইকারের বাসার পূর্ব দিকে একটি পুকুরে চারপাশ থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। পুকুরের পানিও তলানিতে ঠেকেছে।
সেউজগাড়ী পাল পাড়ার একটি পুকুর রয়েছে, যা কয়েক বছর হলো হারিয়ে গেছে। পুকুরটির মালিক রমেশ পাল। তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পুকুরের জমি ভাগবাটোয়ারা হওয়ায় কয়েক বছর হলো নিশ্চিহ্ন হয় এটি।
পাল পাড়ায় ছিল নয়নঝিল। এতে রেলওয়ের যেমন সম্পত্তি ছিল, তেমনি কিছু ছিল ব্যক্তিগত। কয়েক বছরের মধ্যে ঝিলের পানিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে দখল করা হয়েছে এটি।
তালিকার মধ্যে ও বাইরের এসব পুকুর ভরাটে কখনও কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোও কাউকে অবগত করেনি। ফায়ার সার্ভিস বিভাগ তাদের তৈরিকৃত তালিকা পৌরসভাকে দিয়েছে। ক্রমাগত পুকুর ভরাটের কারণে শহরের অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় বিগত সময়ে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় অবগত করেছিল দমকল বিভাগ। কিন্তু পরবর্তীতে এসবের কিছুই আর এগোয়নি।
তালিকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বগুড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ সহকারী পরিচালক খন্দকার আব্দুল জলিল। তিনি বলেন, আমরা সাবমারসিবল দিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছি, এ জন্য কার্যালয়ের পুকুরটি আপাতত প্রয়োজন পড়ছে না। তবে পুকুরটি চালু করার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে।
পুকুরের প্রয়োজনীয়তা আব্দুল জলিল বলেন, সম্প্রতি দেশে বড় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বগুড়াতেও কয়েকটি বড় মার্কেট আছে। এগুলোয় বড় আগুন লাগলে কাছাকাছি পুকুর না থাকায় পানির বন্দোবস্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে পানির সবচেয়ে সহজ প্রাপ্তি হতো করতোয়া নদী। কিন্তু নদী তো প্রায় পানিশূন্য। যে পানি আছে সেখানে ময়লা-আবর্জনা থাকায় ব্যবহার করা যায় না।
জলাধার সংরক্ষণে কোনো কার্যক্রম না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন বগুড়া পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, পুকুর বা জলাধার শুধু অগ্নি নির্বাপনে নয়, আমাদের বাস্তুসংস্থানকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এ হিসেবে এসব জলাধার সংরক্ষণ করাটা আবশ্যক। যদিও কয়েক বছর আগে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ একটা তালিকা দিয়েছিল। কিন্তু এরপর সেটি নিয়ে আমাদের কোনো কাজ করা হয়নি।
বগুড়ায় জলাধার সংরক্ষণে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক রাজিয়া সুলতানা বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখা হবে।