
সবুজ উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা তৈরী ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট।
পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি নিরসনে সিলেট ও বগুড়াসহ কয়েকটি পর্যটন এলাকায় ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করছে একদল গবেষক। এনভায়রনমেন্ট রিসার্চার বাংলাদেশ (ইআরবিডি) নামক পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (এসএইউ) যৌথভাবে ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন।
পর্যটন এলাকায় স্যানিটেশনের অভাব কমানোসহ জৈব সার উৎপাদনই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। পাশাপাশি প্রকল্পটি থেকে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। যারা পরিবেশবান্ধব ব্যবসা পরিচালনা করে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবেন।
‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ একটি পরিবেশবান্ধব, আধুনিক প্রযুক্তির পাবলিক টয়লেট। এই টয়লেটে আছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা, সোলার প্যানেল, সয়ংক্রিয় অর্থ প্রদান ও নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। যার কারনে এটি সহজে পর্যটন এলাকা ও লোকালয়ের বাহিরের স্থাপন করা যাবে, এমনকি বড় শহরেও। সোলার সিস্টেম রাত ও দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে, ওয়াশ বেসিনের জন্য কাঁচের গ্লাস ব্যাবহৃত হবে। আরো একটি আকর্ষনীয় বিষয় হলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ছাদের প্রাথমিক ধাপগুলো সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কাঁচ দিয়ে তৈরি হবে যা একজন ব্যবহারকারীর মাঝে পজিটিভ ইমেজ তৈরি করবে।
অবশেষে এই পরিবেশসম্মত আধুনিক পাবলিক টয়লেটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এমন হবে যে এর দ্বারা নিকটবর্তী নদী বা পানির আধার দূষণ হবে না। বরং চারকোল, ভার্মি কম্পোস্ট ও পচনশীল ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে। এর ফলে প্রকৃতি জলবায়ু উষ্ণকরণের ক্ষতিকারক গ্যাস হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত প্রাকৃতিক সার গাছের খাদ্য হিসাবে প্রকৃতির সবুজায়নে ব্যবহৃত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবুজ উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা তৈরী, এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সিলেট আর বগুড়ার পর্যটন এলাকায় গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেটের কাজ করা হবে। পরবর্তীতে দেশের সবগুলো পর্যটন এলাকায় এই উদ্ভাবনী বিষয় নিয়ে কাজ করার প্রস্তাবনা আছে। এনভায়রনমেন্ট রিসার্চার বাংলাদেশ (ইআরবিডি) এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (এসএইউ) যৌথভাবে ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করছে।
প্রকল্পে চার সদস্যের দলটিতে কাজ করছেন বগুড়ার দুই গবেষক। এই দুই জন হলেন মো. আতিকুর রহমান মল্লিক ও ফারাহ্ নাজনীন। তাদের দুজনের বাড়ি সদর উপজেলায়। এর মধ্যে আতিকুর রহমান অনুসন্ধানী ক্রিডস লিমিটেড নামক একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ হিসাবে কর্মরত আছেন। আর ফারাহ্ নাজনীন পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউট,বুয়েট এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন ।
তারা জানান, পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধির অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য ‘সবুজ অর্থনীতি’ গঠনে ব্যাপক ভূমিকার রাখবে ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই আইডিয়াটি ফলপ্রসু হয়ে উঠেছে।
গবেষকদের টিম লিডার হলেন মোহাম্মদ মেহেদী হাসান খান। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বায়োকেমিস্ট্রি ও রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান। অপর সদস্য হলেন পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রাশা বিনতে মহিউদ্দিন।
গবেষকরা জানান, মানব সভ্যতার মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রাটা হবে একমূখী! পৃথিবীতে ফিরে এসে খাবার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সুতরাং মানুষকে সেখানেই খাবার উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের মাটি পাথর অর্গানিক (জৈব) উপাদন নেই। তাই হিউম্যান ওয়েস্ট তথা মনুষ্য বর্জ্য হতে পারে একমাত্র জৈব উপাদানের সূত্র।
সেই উদ্দেশ্যে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা খুবই সহজ ও প্রাকৃতিক উপায়ে এই বর্জ্য থেকে প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া সরিয়ে কম্পোস্ট বানানোর উপায় বের করেন। এই পাবলিক টয়লেট একটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে জার্মানির হামবুর্গ এবং বার্লিনে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার পেছনে আছেন বেশ কিছু গবেষক, পিএইচডি এবং মাস্টার্স স্টুডেন্ট। যেটা পরবর্তীতে সিনেমা বানানো হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে অ্যাকশন এইডের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৯০ শতাংশ জনসাধারণের টয়লেট অব্যবহৃত, ৯০ দশমিক ১ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর, ৯৬ শতাংশ অনিরাপদ এবং ৫৪ শতাংশ এএফএটি স্যানিটেশন সুবিধাগুলির অভাব রয়েছে।
পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব একটি পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ বাস্তবায়নে কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটির প্রথম ধাপে স্থান নির্বাচনের কার্যক্রম শেষ করবে। প্রাথমিকভাবে সিলেট, বগুড়ার কয়েকটি পর্যটন এলাকায় গবেষক দলটি কাজ করবে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য পর্যটন এলাকায় এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হবে।
কেন এই ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ এমন প্রশ্নে প্রকল্প গবেষক আতিকুর রহমান মল্লিক জানান, যেকোনো বানিজ্যিক উদ্যোগে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অবহেলিত থাকে, আবার পরিবেশ রক্ষার কার্যক্রমে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়া যায় না, কিন্তু ‘গ্রিন আইবি চ্যাম্পিয়ন্স ২০২১’ এর মতো উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবে এবং আমাদেরকে সহযোগিতা করতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসবে।
তিনি আরও জানান, আমরা আশাবাদী এই প্রকল্প থেকে দেশে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। আমরা প্রাথমিকভাবে পর্যটন এলাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। পরবর্তীতে এটি দেশের বিভিন্ন শহরে চালু করা হবে।
চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি ‘গ্রিন আইবি চ্যাম্পিয়ন্স ২০২১’ নামক একটি প্রতিযোগীতায় প্রথম ১০টির মধ্যে ‘গ্রিনিং ফ্রম ইকো টয়লেট’ প্রকল্পটি নির্বাচিত হয়। এই প্রতিযোগীতায় দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৮০টি সবুজ উদ্যোগের আইডিয়ার নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। পরিবেশ বান্ধব উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা তৈরি এবং পরিবেশ বান্ধব ব্যবসা সম্প্রসারণে এ প্রতিযোগীতার আয়োজন করে গ্রিন-টেক ফাউন্ডেশন। কোনও ব্যবসায়িক ধারণা বা নতুন উদ্যোগে কোনও ধরনের ব্যবসায়িক বান্ধব সরবরাহ করার উদ্দেশ্য এবং উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে এই আয়োজন।