Joy Jugantor | online newspaper

জলবায়ু পরিবর্তন যদি শার্ক হয়

পানি শার্কের দাঁত!

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৪ আগস্ট ২০২১

পানি শার্কের দাঁত!

সংগৃহীত ছবি

এবার আর কোনো অজুহাতে কাজ হবে না, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। তারপরও মানুষের বুঝতে এত কষ্ট কেন? নাকি মানুষ বুঝতেই চায় না, প্রকৃতির কী বেহাল দশা হয়েছে।

গেল কয়েক মাসে প্রকৃতি যে বৈরী রূপ নিয়েছে, এ রূপ আগে মানুষ দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ খরা দেখা দিয়েছে। বন্যায় ভাসছে চীন আর জার্মানি। প্রতিবারই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নতুন করে রেকর্ড ভাঙছে। পানিবাহিত যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সবই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানুষ, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি সব পানির নিচে চলে যাচ্ছে।
 
আমেরিকান মেটেওরজিক্যাল সোসাইটির গবেষক জেমস পি ব্রুস বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন যদি শার্ক (হাঙর) হয়, পানি শার্কের (হাঙর) দাঁতের মতো কাজ করে। এখন শার্ক (হাঙর) সমুদ্রের ওপরে উঠে এসেছে, তাই আমরা এত ভোগান্তিতে আছি।
 
চলতি বছরের গ্রীষ্মে বিভিন্ন অঞ্চলের ভয়াবহ এ তাপদাহ মানুষেরই সৃষ্টি। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন প্রোজেক্ট বলছে, তাপদাহ এত ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে মানুষের কার্বন নিঃসরণের কারণে। কারণ এ ধরনের তাপদাহ হাজার বছরে একবার হওয়ার কথা।
 
২০২১ সালের জুন মাস আমেরিকানদের জন্য রেকর্ড তাপদাহের মাস ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ৮০টির মতো দাবানল ছিল। ২০০০ সালের পর ১০টি বড় দাবানলের বছর ২০২১। এর কারণে যদি খরা হয়, খাদ্যপণ্যের দাম চলতি বছরই ৪০ শতাংশ বাড়বে।
 
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সাক্ষী সারাবিশ্ব। জার্মানি বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। মারা গেছে অনেক মানুষ, আর্থিক ক্ষতি ৭০০ কোটি ডলার। চীনের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
 
জলবায়ুর বর্তমান অবস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে আর বেশি দেরি নেই। তাপদাহ মানেই পানি বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে, অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে, ঋতুর পরিবর্তনের কোনো ধারাবাহিকতা থাকছে না। ফলাফল কোনো স্থানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, আবার কোনো স্থানে বৃষ্টিই হচ্ছে না।
 
গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মতো বৃহত্তম অর্থনীতির দেশসহ অন্তত ৫৭টি দেশ অতিরিক্ত পানি সংকটে পড়বে। এরমধ্যে আছে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা আর মধ্য এশিয়াও। ২০৪০ সালে পানি স্বল্পতার ভয়াবহতা দেখবে এ দেশগুলো। গবেষকরা জলবায়ু পরিবর্তন আর সারাবিশ্বের প্রাকৃতিক দুর্যোগের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে।
 
জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর যে পরিমাণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে, তা গেল ৫০ বছর আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি। এরমধ্যে মানুষ পৃথিবীকে উষ্ণ করার কারণে খরা, বন্যা আর তাপদাহ হচ্ছে। গ্রিন হাউস গ্যাসের জন্য সারাবছর ঠাণ্ডা থাকা সাইবেরিয়ার তাপমাত্রা বেড়েছে।
 
পাকিস্তানের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্য তো একই বছরে খরা, টর্নেডো আর অতিরিক্ত শীত মৌসুম পেয়েছে।  যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় শীত মৌসুমে হালকা তুষারপাত হয়, বসন্তে হালকা বৃষ্টি। কিন্তু এ বছরের গ্রীষ্ম তো ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য আগুনের মৌসুম এনে দিয়েছে। তাপদাহের কারণে খরা আর ভয়াবহ দাবানল দেখেছে ক্যালিফোর্নিয়া। মাটির নিচেও পর্যাপ্ত পানি নেই যা দিয়ে কৃষিকাজ করবেন এখানকার কৃষক। পানির জন্য অন্য অঙ্গরাজ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া। গেল কয়েকবছরের দাবানলে নষ্ট হয়েছে অনেক কৃষিজমি।
 
বরফে ঘেরা পৃথিবীর মেরু অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকায় সবচেয়ে দ্রুত বিশ্ব উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গেল ৫০ বছরে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এখানকার তাপমাত্রা।
 
পৃথিবীতে জলবায়ু সংকটের গুরুত্বপূর্ণ সব সংকেতগুলো দিনদিন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। জলবায়ু সংকটের ৩১টি সংকেতের মধ্যে ১৬টির অবস্থা করুণ।এরমধ্যে আছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়া আর বরফখণ্ড ভেঙে যাওয়া। পরিবেশ বিষয়ক বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধীরে ধীরে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, যেখান থেকে পৃথিবীকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
 
প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড করছে পরিবেশ দূষণের সব অনুষঙ্গ। করোনা মহামারির কারণে সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যখন স্থবিরতা নেমে আসে, তখন কার্বন নিঃসরণ কিছুটা কমেছে। কিন্তু বায়োসায়েন্সের প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ আর ২০২১ সালে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন আর নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণ রেকর্ড করেছে।
 
ব্রাজিলের বন আমাজন ২০১৯ আর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হয়েছে। গেল ১২ বছরের মধ্যে এই দুই বছরে ১০ লাখ হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে আমাজনের।
 
সমুদ্রের পানিতে এসিডের উপস্থিতিও গেল কয়েক বছর ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেছে। কোরাল রিফগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে কারণ সমুদ্রের পানি উষ্ণ হচ্ছে, অথচ কোরাল রিফের ওপর অন্তত ৫০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। মানুষ খাবার, পর্যটন আর ঝড় থেকে রেহাই পেতে কোরাল রিফের ওপর নির্ভর করে।
 
পৃথিবীর মোট কার্বন নিঃসরণের ৮ শতাংশই আসে খাবারের অপচয় থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবছর ৭৩ লাখ টন খাবারের অপচয় হয়। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ডলার। শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, সারাবিশ্বে প্রতিদিন ১৩০ কোটি টন খাবারের অপচয় হয়, যেখান থেকে বিষাক্ত মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে যায়। সারাবিশ্বে ৮১ কোটি মানুষ খালি পেটে বিছানায় যায়, যেখানে ২০০ কোটি মানুষ অতিরিক্ত খায়।