
ছবি: সংগৃহীত
অস্থায়ী বাঙ্কারে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা চারজন লোক সবুজ ধানক্ষেতের দিকে মুখ করে রয়েছে, আর তাদের বন্দুকগুলো সিমেন্টের বস্তার দেয়ালে বিশ্রাম নিচ্ছে। বাড়িতে তৈরি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়।
এরা সবাই বেসামরিক ‘গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর’ সদস্য। তাদের মধ্যে একজন গাড়ি চালক, একজন শ্রমিক, একজন কৃষক এবং তোম্বা (যার নাম আমরা তার পরিচয় রক্ষা করার জন্য পরিবর্তন করেছি) রয়েছেন। ভারতের উত্তর-পূর্ব মণিপুর রাজ্যে মে মাসে ভয়াবহ জাতিগত সংঘাত শুরু হওয়ার আগে তোম্বা একটি মোবাইল ফোন মেরামতের দোকান চালাতেন।
বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতির দেশ ভারতের এই অঞ্চলে জাতিগত বিচ্ছিন্নতা একটি ভারী-সামরিকীকরণকৃত সীমান্ত বিচ্ছিন্ন দেশগুলির মতো যুদ্ধে বিভক্ত।
তোম্বা বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে, কারণ আমরা মনে করি না অন্য কেউ এটি করবে। আমি ভয় পাই কিন্তু আমাকে সেই অনুভূমি লুকিয়ে রাখতে হবে।’
তোম্বা এবং বাঙ্কারে থাকা অন্য তিনজন সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি সম্প্রদায়ের। এরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
মেইতি সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়াবহ সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে মণিপুরে আতঙ্কের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে। সংঘাত চলাকালে নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। সহিংসতায় দুই শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কুকি সম্প্রদায়ের। বাকীরা জোমি, চিন, হামার এবং মিজো উপজাতির, যাদের বেশিরভাগই খ্রিস্টান।
গত ৪ মে দুই কুকি-জোমি নারীকে নগ্ন করে সারা গ্রাম ঘুরিয়েছিল মেইতি পুরুষদের একটি দল। এদের মধ্যে এক তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই তরুণীর বাবা এবং 19১৯ বছর বয়সী ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ওই তরুণীর মা বিবিসিকে বলেন,‘আমার স্বামী এবং ছেলের হত্যাকাণ্ডের পর এবং আমার মেয়ের সাথে কেমন আচরণ করা হয়েছিল তা দেখার পর আমি আার বাঁচতে চাই না। আমার স্বামী গির্জার প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন। তিনি নরম কথার মানুষ ও দয়ালু ছিলেন। তার হাত ছুরি দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছিল। আমার ছেলে ছিল ১২তম ক্লাসে পড়তো। সে ছিল ভদ্র ছেলে এবং কখনও কারো সাথে মারামারি করেনি। তাকে নির্মমভাবে রড দিয়ে পেটানো হয়েছিল।’
ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিতে গিয়ে ওই মা বলেন, ‘তাকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ সে তার বোনকে বাঁচানোর জন্য তাদের [জনতার] পিছনে দৌঁড়েছিল। আমার মেয়েকে বাঁচানো যায়নি। তার সামনেই বোনকে হত্যা করা হয়েছিল।
সর্বহারা এই নারী বলেন, ‘আমার এখন খেতে ও ঘুমাতে সমস্যা হয়। আমার পরিবারের সাথে যা করা হয়েছে তারপর আমি কখনই শান্তিতে থাকতে পারি না।
মে মাসে পুলিশ এ বিষয়ে একটি অভিযোগ নথিভুক্ত করলেও জুলাই মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনার ভিডিও প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোনও তদন্ত হয়নি। তখনই মণিপুরের সংঘাত ভারতে এবং সারা বিশ্বের অনেকের নজর কেড়েছিল।
তোম্বার অবস্থান থেকে এক মাইলেরও কম দূরে একই রকম বাঙ্কারে একটি ডাবল ব্যারেল শটগান ধরে বসে আছেন খাখাম (তার আসল নাম নয়)। তিনি কুকি-জোমি উপজাতির কৃষক।
খাখাম বলেন, ‘আমরা এখানে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমরা সহিংসতা চাই না। আমরা মেইতিদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরতে বাধ্য হচ্ছি। এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেখানে পুলিশ তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে দিয়েছে। তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না।’
উভয় পক্ষে যুদ্ধের ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। দুটি বাঙ্কারের মধ্যবর্তী এলাকাটিকে ‘সম্মুখ সারি’, ‘বাফার জোন’ বা ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
খাখাম বলেন, ‘আমরা আর কখনই মেইতিদের সঙ্গে থাকতে পারব না। এটা অসম্ভব।’
সহিংসতার বিবরণ শুনলে শত্রুতা এত দ্রুত কীভাবে তিক্ত এবং গভীর হয়ে উঠেছে তা সহজেই বোঝা যায়।
কুকি-হামার উপজাতির ৩৩ বছর বয়সী ডেভিড টুওলোর ছিলেন লাংজা ‘গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর’ সদস্য। ডেভিডের পরিবার জানিয়েছে, তাকে তার গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় এবং ২ জুলাই মেইতি জনতা তাকে হত্যা করে। ডেভিডের মৃত্যুর পরপরই অনলাইনে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তার ক্ষতবিক্ষত বিচ্ছিন্ন মাথাকে বেড়ার উপর আটকে থাকতে দেখা যায়।
ডেভিডের ছোট ভাই আব্রাহাম জানান, তার ভাইকে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ডেভিডের দেহ পোড়ানো হয়েছিল। তারা কেবল কয়েকটি হাড় খুঁজে পেয়েছে।
৭ জুলাই ডেভিডের মৃত্যুর পাঁচ দিন পর এনগালিবা সাগোলসেম নামে মেইতি সম্প্রদায়ের ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ নিখোঁজ হন। একজন মেইতি লোক, উত্তর মণিপুরের একটি কুকি-অধ্যুষিত এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। দুই মাস পর প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তার মাথায় গুলির পর তার লাশ নর্দমায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
মণিপুরে ক্ষমতায় রয়েছৈছে ভারতের শাসক দল বিজেপির রাজ্য শাখা। মেইতি এবং কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন জানিয়েছেন, তারা মণিপুর রাজ্য সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট। কুকিদের ভাষ্য, রাজ্য সরকার তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে সমর্থন করছে। আর মেইতিদের অভিযোগ, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে রাজ্য সরকার কিছুই করেনি।
মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের কার্যালয় একটি সাক্ষাত্কারের জন্য বিবিসির অনুরোধ বা ইমেলের মাধ্যমে পাঠানো প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কুকিরা মণিপুরে তাদের জন্য পৃথক প্রশাসন বা সরকার দাবি করেছে। মেইতিরাও সাফ জানিয়েছে, তারা কুকিদের সঙ্গে একসাথে বসবাসে রাজী নন। সব মিলিয়ে হাজার হাজার সশস্ত্র, ক্ষুব্ধ এবং ভীত বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ে রাজ্যের পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত অস্থিতিশীল।