Joy Jugantor | online newspaper

চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা : নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত?

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২৫ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ০৯:০১, ২৫ অক্টোবর ২০২১

চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা : নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত?

সংগৃহীত ছবি

চীন সম্প্রতি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন) ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার খবরকে মোড় বদলানো একটি ঘটনা হিসেবে দেখছেন অনেকে। এ পরীক্ষার খবর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে চমকে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে এমনটি বলা হয়েছে।

গ্রীষ্মকালে চীনের সামরিক বাহিনী দুবার মহাকাশে এমন রকেট উৎক্ষেপণ করে, যা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে লক্ষ্যবস্তুর দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে যায়। প্রথম বার সেটি লক্ষ্যবস্তুর প্রায় ২৪ মাইল দূর দিয়ে চলে গেলে নিশানায় আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ক এক ব্রিফিং থেকে যাঁরা এ তথ্য জানতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম এ খবর প্রকাশ করে লন্ডন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ক প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিক ও ভাষ্যকার চীনের এ উন্নতিতে শঙ্কা প্রকাশ করেন। বেইজিং অবশ্য তড়িঘড়ি এ রিপোর্ট নাকচ করে দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে জানায়, তারা আসলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশযান পরীক্ষা করছিল।

ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরেতে মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র বিস্তার রোধ বিষয়ক গবেষণার পরিচালক জেফ্রি লিউইস চীনের এ অস্বীকৃতিকে তাদের বিষয়টি ‘ঘোলাটে করার প্রয়াস’ হিসেবে দেখছেন। কারণ তিনি বলছেন, অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও এ পরীক্ষার কথা নিশ্চিত করেছেন।

জেফ্রি লিউইস আরও মনে করছেন, মহাকাশ কক্ষপথে এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চীন পরীক্ষা চালিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা ‘কারিগরি সক্ষমতার দিক থেকে এবং কৌশলগত কারণে’ চীনের পক্ষে করা খুবই সম্ভব।

আইসিবিএম ও এফওবিএস কী?

আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম হলো দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে ছুটতে পারে, আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। এ ক্ষেপণাস্ত্র অধিবৃত্তাকার গতিপথ ধরে নিশানার দিকে ছোটে।

অন্যদিকে,  ফ্র্যাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম বা এফওবিএস পদ্ধতিতে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হয় আংশিকভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে, যাতে অপ্রত্যাশিত কোনো স্থান থেকে তা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক অ্যারন স্টেইন বলছেন, ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবর এবং চীনের অস্বীকৃতি দুটোই সত্য হতে পারে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশযানও একটি হাইপারসনিক গ্লাইডার। গ্লাইডার জাতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে এফওবিএস ব্যবহার করলে সেটা একটা পুনর্ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযানের মতোই কাজ করবে। কাজেই দুটি বক্তব্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা খুবই নগণ্য।’

কয়েকমাস ধরে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাও এমন ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, চীন এ প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে। এফওবিএস আসলে নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে কাজ করেছিল এবং চীন এখন মনে হচ্ছে, সে প্রযুক্তি নিয়ে এগোনোর কাজটি পুনরুদ্ধার করছে। এ পদ্ধতিতে ছোঁড়া অস্ত্র পৃথিবীর কক্ষপথে আংশিকভাবে ঢোকে, ফলে কোন দিক থেকে সেটি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করবে, সেটা আন্দাজ করা সম্ভব হয় না।

ধারণা করা হচ্ছে—চীন এখন যেটা করেছে সেটা হলো, এফওবিএস প্রযুক্তিকে হাইপারসনিক গ্লাইডারের সঙ্গে সংযুক্ত করে নতুন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছে। এ প্রযুক্তিতে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গা ঘেঁষে চলে, যে কারণে কোনো রাডারে তা ধরা পড়ে না বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সেটাকে ধ্বংস করাও সম্ভব হয় না।

চীনের লক্ষ্য কী?

জেফ্রি লিউইস বলছেন, ‘চীনের আশঙ্কা, তাদের পরমাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা সমন্বিত ভাবে ব্যবহার করবে।’

অন্যদিকে, অ্যারন স্টেইন বলছেন, ‘পরমাণু শক্তিধর বড় দেশগুলোর বেশির ভাগই এখন হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। তবে, এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তফাৎ রয়েছে।’ তাঁর মতে, দৃষ্টিভঙ্গির এ তফাৎই এক দেশকে আরেক দেশের অভিপ্রায় নিয়ে অতিমাত্রায় সন্দিগ্ধ করে তুলছে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মূল ইন্ধন যোগাচ্ছে।

অ্যারন স্টেইনের বিশ্বাস, চীন ও রাশিয়া মনে করে—হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাজিত করার নিশ্চিত একটা প্রযুক্তি। অন্যদিকে, পারমাণবিক অস্ত্রের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়—এমন লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

চীনের ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’

যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তির দ্রুত আধুনিকায়নকে যাঁরা সমর্থন করেন, তারা চীনের সাম্প্রতিক পরীক্ষাকে দেশটির ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন মহাকাশের কক্ষপথে সফলভাবে তাদের উপগ্রহ পাঠায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত সাফল্যে এ ধরনের বিস্ময় ও শঙ্কা প্রকাশ করেছিল।

তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁরা মনে করেন না যে, চীনের এ সাম্প্রতিক পরীক্ষা নতুন করে কোনো হুমকি সৃষ্টি করেছে। কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশানাল পিস-এর জেমস অ্যাকটন বলছেন, অন্তত ১৯৮০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তারা চীনের দিক থেকে পারমাণবিক হামলার হুমকিতে রয়েছে।

জেমস অ্যাকটন মনে করেন, ‘চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাস্ত করতে যেভাবে উঠে পড়ে এগোচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র এখন দেখতে চাইবে এ ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সীমিত রাখতে বিধিনিষেধ আরোপ করে যেসব চুক্তি রয়েছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করবে কি না।

জেফ্রি লিউইস জোর দিয়ে বলছেন, ‘এখানে যুক্তরাষ্ট্রকে ঝুঁকিটা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আমার আশঙ্কা—বিষয়টি নাইন-ইলেভেনের মত না হয়ে দাঁড়ায়! ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর দিশেহারা হয়ে আবার হামলার ঝুঁকি ও আশঙ্কা থেকে আমরা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একের পর এক বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা আমাদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সব প্রতিপক্ষ দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার আধুনিকায়ন ও সমৃদ্ধ করছে। চীনের অস্ত্রসম্ভার যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় নগণ্য। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত করার প্রযুক্তি নিয়ে উদ্‌বেগ থেকেই চীন তাদের পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার আরও উন্নত, আরও শক্তিশালী করছে।

উত্তর কোরিয়াও বসে নেই। তারাও তাদের পরমাণু সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং আধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে। কার্নেগি এনডাওমেন্টের অঙ্কিত পান্ডা বলছেন, ‘সাম্প্রতিক কয়েক বছরে উত্তর কোরিয়া নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হিসেবে দাবি করে আসছে। এবং তারা মনে করছে—রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা বাড়াতে এবং সম্মান অর্জন করতে অত্যাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র এবং শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার বিকল্প নেই।’

পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার এ প্রতিযোগিতা বাইডেন প্রশাসনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যেসব চুক্তি চলে আসছে, তার অনেকগুলোই এখন আর সময়োপযোগী নয়। মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েনও অস্বস্তির একটা বড় কারণ।

অঙ্কিত পান্ডা বলেন, ‘অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার এই দৌড়, অস্ত্র তৈরির এই প্রতিযোগিতা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থবহ একটা পথ হবে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যাওয়া। একমাত্র আলোচনার মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে একটা অর্থবহ চুক্তি বা সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব। আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো ছাড় আদায় করতে পারলে, তবেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক এই দৌড়ে রাশ টানা সম্ভব।’