Joy Jugantor | online newspaper

মোঘল আমলের স্বাক্ষী বগুড়ার মাদলা জমিদার বাড়ি

মিজানুর রহমান

প্রকাশিত: ১৫:১৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৫:২৩, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

মোঘল আমলের স্বাক্ষী বগুড়ার মাদলা জমিদার বাড়ি

মাদলা বন্দর এলাকায় ৩৩ বিঘা জমির উপরে এ প্রাচীন প্রাসাদ

প্রাচীন পুন্ড্রনগর বগুড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নবাব-জমিদারদের অনেক স্মারক স্থাপনা। প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে জমিদার বিশ্বনাথ সরকার গোড়াপত্তনকৃত মাদলা জমিদার বাড়িটি তারমধ্যে অন্যতম। শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা বন্দর এলাকায় ৩৩ বিঘা জমির উপরে এ প্রাচীন প্রাসাদ। স্থানীয়দের কাছে এটি মাদলা  জমিদার বাড়ি বলে এখনো পরিচিত। 

প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে মোঘল আমলে জমিদার বিশ্বনাথ বগুড়ার নবাবের কাছ থেকে এই জমিদারি নেয়। জমিদারি সময়ে সেখানে মাসব্যাপী রথ উৎসব পালন করা হত। বিভিন্ন এলাকার অনেক লোকজন আসত। বাড়ির চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীর বেষ্টনী এবং মোট ৭ টি ফটক নিরাপত্তায় পাইক পেয়াদারা দ্বায়িত্ব পালন করত।

বর্তমানে জমিদারী না থাকলেও জমিদারের বংশধররা প্রাচীন এ নিদর্শনটি টিকিয়ে রেখেছেন। মাদলা হাট থেকে পূর্ব দিকে সামান্য এগিয়ে মাদলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পাশ দিয়ে জমিদার বাড়ি মূল রাস্তা।জমিদার বাড়ির মূল রাস্তার দু'ধারে প্রাচীন বৃক্ষের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা নিয়ে যাবে প্রধান ফটক তারপর ঘাটবাধাঁনো বিরাট পুকুর উপরে জমিদার বাড়ি। 

সরেজমিনে মাদলা জমিদার বাড়ি ঘুরে এবং জমিদারের বংশধরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমিদার বাড়িতে আগে প্রায় সন্ধ্যায় রঙিন আলোর বাইজির নাচ গান আর সুরের নেশায় মুখর ছিল জলসা ঘর। জৌলুস বিহীন ভগ্নাবশেষ এখন শুধু স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে দূর্গ আকৃতির প্রাচীন নিদর্শন দেখা যায়। জমিদারি সিংহদ্বার এখনো বিদ্যমান। ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এই বাড়িটি শৈল্পিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ছিল উঁচু প্রাচীর আর ৭টি প্রধান ফটকে বেষ্টিত। 

জমিদার বাড়ি বউ অঞ্জনা রানী ঘোষ সরকারি চাঁচাইতারা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকা পুরো জমিদার বাড়ির ধন সম্পদ ব্যাপক হারে লুন্ঠন চালায় দুর্বৃত্তরা। স্বর্ণের গহনা, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে জমিদার বাড়ির দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরবর্তীতে জমিদার বাড়ি কিছু নিদর্শন টেবিল, চেয়ার ও আসবাবপত্র স্থানীয় শিক্ষার্থীদের ইতিহাস চর্চায় সরকারি চাঁচাইতারা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে দিয়েছি। বিদ্যালয়ের জায়গাও জমিদার বাড়ির দান করা জমি এটার আমাদের গর্বের বিষয়। জমিদার বাড়িতে এখনো ছোট বড় সব অনুষ্ঠানে জমিদার বংশের সবাই একত্রিত হন। প্রতিনিয়ত জমিদার বাড়ির প্রাচীন নিদর্শন দেখতে বিভিন্ন জায়গার মানুষ আসেন। আমরা জমিদার বাড়িতে প্রতি বছর পূজায় জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়।’ 

জমিদার বাড়ির ছেলে ও শাজাহানপুর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক  তপু কুমার সরকার তাপস বলেন, ‘বিশ্বনাথ সরকার পরে জমিদারির দায়িত্ব পান তার ছেলে  সুরেন্দ্র নাথ সরকার ও নরেন্দ্র নাথ সরকার। তাদের মৃত্যুর পরে নরেন্দ্রের ছেলে বিমলেন্দ নাথ সরকার এবং সুরেন্দ্রনাথের ছেলে ক্ষীতেন্দ্রনাথ সরকার জমিদারি দেখাশুনা করতেন। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তারা জমিদারি করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দুর্বৃত্তরা একমাস ধরে লুন্ঠন করে। সে সময় জমিদারি বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই জমিদারী ষ্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল নাটোর, সিংড়া, সিরাজগঞ্জ, তাড়াশ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, বগুড়ার মাদলা, খরনা, গাবতলীর তরনী, শেরপুর, কুসুম্বি তাজপুর, মির্জাপুর, পূর্ব বগুড়াসহ শেলবর্ষ পরগনার কাহালু ও ঢাকস্থা মহাল। 

তিনি আরও জানান, মাদলা হাট, মাদলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র মাদলা পোস্ট অফিস, চাঁচাইতারা উচ্চ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, অসংখ্য মাদ্রাসা, মক্তব, মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জায়গা জমিদার বাড়ি দান করেছেন। এছাড়াও অনেক জায়গার জাল দলিল তৈরি করে অনেকে দখল করে রাখছেন। 

জমিদার বিষয়ে সরকারী কমরউদ্দিন ডিগ্রী কলেজের ইতিহাস সহকারি অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) আওরঙ্গজেব বলেন, ‘ইংরেজ শাসনামলে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে জায়গীরদারি প্রথা বিলুপ্ত করে জমিদারী প্রথা চালু করেন। এই প্রথা দিয়ে উপমহাদেশকে আরও সহজভাবে শাসন করার জন্য তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় এদেশে শতাধিক জমিদাররা রাজস্ব আদায় জন্য ব্রিটিশদের কাছ থেকে চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ছিল। জমিদাররা শাসনকার্য পরিচালনা করতে প্রাসাদ তৈরি করে সেখানে বিচারকাজ পরিচালনা ও বসবাস করতেন। সেটাই জমিদার বাড়ি নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে  শেরে বাংলা ফজলুল হক সরকাররে ১৯৩৮ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রজাজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে প্রজারা জমির প্রকৃত মালিক হন এবং ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় । 

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১০০ বছরের পূবের ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি গেজেট  প্রকাশের সংরক্ষণ করে। মাদলা জমিদার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে তেমন তথ্য নেই। প্রত্নতত্ত পক্ষ থেকে বাড়িটি পরিদর্শন করা হবে।