Joy Jugantor | online newspaper

নিজ জন্মস্থানে অচেনা বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী! 

রবিউল ইসলাম রবি

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ১৭ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১৫:৪২, ১৭ আগস্ট ২০২১

নিজ জন্মস্থানে অচেনা বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী! 

সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলার বিহারে প্রফুল্ল চাকীর নামফলক ও ৪ শতাংশ মাটির ঘরে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।

প্রফুল্ল চাকী একটি বিপ্লবের নাম। একটি চেতনার নাম। ইতিহাসের সোনালী পাতায় জায়গা করে নেওয়া আপসহীন যোদ্ধার নাম। সবার কাছে তার একটাই পরিচয় বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী । তার আসল নাম প্রফুল্ল চন্দ্র চাকী। সেই বিপ্লবীই নিজ জন্মভূমিতে অনেকটাই অচেনা। শিশু কিশোর ও মধ্য বয়সি অনেকেই তাকে ভালো চেনে না। অনেকে আবার নামও শুনেনি।

তার গ্রামের প্রতিবেশি ছাড়া ধামাহার, সচিয়ানি, সংসারদীঘি ভাসুবিহার, চাঁনপাড়া এলাকাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রফুল্ল চাকীর কথা জিজ্ঞাসা করলে কেউ তাকে চিনতেই পারেননি।

সম্প্রতি সরেজমিনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এই বিপ্লবীর বাড়ি বিহার পোদ্দার পাড়ায় গেলে স্থানীয়রা জানান, প্রফুল্ল চাকীর ২৬ শতক জমি পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের বাড়ির যায়গা ছাড়া সব কিছুই বিলিন হয়ে গেছে কালের গহবরে। শতবর্ষী একটি চালতার গাছ ছাড়া তাদের কোন স্মৃতি এখানে অবশিষ্ট নাই। গ্রামের ময়লা আবর্জনাও ফেলা হয় তাদের জায়গায়। ২০১৭ সালে এখানকার একটি গাছ বিক্রি করে প্রফুল্ল চাকীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি নামফলক নির্মাণ করা হয়। যা বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া বিহার বাজারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও মাটির ঘরই তাকে স্মরণের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও চাকী স্মৃতি সংসদ তৈরি করা হলেও নানা কারণে তা আলোর মুখ দেখছে না।

স্থানীয় বাসিন্দা শ্রী সুশীল চন্দ্র ও রবিউল জানান, প্রফুল্ল চাকীর ২৬ শতক এই জমিতে ১৫ বছর আগে পাঠাগার ও একটি বিদ্যালয় স্থাপনের কথা শোনা গেলেও আজ অবধি তা নির্মাণ করা হয়নি। দেখ-ভাল করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি গঠনমূলক কোন উদ্যোগ।

সংসারদীঘি গ্রামের সাদেক বলেন, প্রফুল্ল চাকীকে নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী কিছু না করায় নতুন প্রজন্ম ও মধ্যে বয়সীদের কাছে অচেনা মানুষে পরিণত হয়েছে।

নারায়ণ শহর গ্রামের আজিজার বলেন, অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এসেছে দেখেছে আবার চলেও গিয়েছে। কিন্তু চাকীর স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার জন্য নেওয়া হয়নি বড় কোন উদ্যোগ। 

বিহার গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়া প্রফুল্ল চাকীকে স্মরণের আর কিছুই নেই। একটি মাটির ঘরে প্রয়াত রওশন মাস্টার প্রফুল্ল চাকী স্মৃতি সংসদ তৈরি করলেও তা এখন অকেজ হয়ে পরে আছে।

বিহার বাজারে প্রতিষ্ঠিত চাকী স্মৃতি সংসদের বর্তমান সভাপতি মিনহাজ রহমান বলেন, আমরা সরকারের কাছ থেকে কিছু অনুদান পেয়েছিলাম যা দিয়ে বিহারে প্রফুল্ল চাকীর নামফলক ও ৪ শতাংশ মাটির ঘরে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু টেবিল চেয়ারও আছে। 

তিনি আরও বলেন, মাটির ভাঙ্গা ঘরটি পাকা ও ঐ ঘরে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। প্রফুল্ল চাকীর বাড়ির পতিত জায়গাটিতে একটি স্কুল নির্মানের জন্যও  আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বিহার ইউপি চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম বলেন, আগেতো প্রফুল্ল চাকীকে স্মরণের কিছুই ছিলো না। আমার সহযোগীতায় ২০১৮ সালের ৬ ডিসেস্বর বিহার বাজারে যুগযুগ ধরে চাকীকে স্মরণ করার জন্য স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। সামনে আরও দৃশ্যমান ভালো কিছু করা হবে।

বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যক্তিত্ব মীর লিয়াকত আলী বলেন, প্রফুল্ল চাকীর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য  অনেক আগেই ভালো কিছু করার দরকার ছিলো। এটা আমাদের ব্যর্থতা আমরা কিছুই করতে পারিনি। এখনই কিছু না করতে পারলে তার পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। 

এব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম সম্পা গণমাধ্যমকে জানান, প্রফুল্ল চাকী ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তার স্মৃতি রক্ষার জন্য খুব শীঘ্রই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার জন্মস্থানটি অচিরেই  সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া স্থানটি দর্শনীয় করতে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়কে অনুরোধ জানানো হবে।

প্রসঙ্গত প্রফুল্ল চাকী ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত বগুড়া জেলার বিহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তাঁকে বগুড়ার ‘নামুজা জ্ঞানদা প্রসাদ মধ্য বিদ্যালয়ে’ ভর্তি করানো হয়। পরবর্তীতে তিনি বগুড়ার মাইনর স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০২ সালে রংপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পূর্ব বঙ্গ সরকারের কারলিসল সার্কুলারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে তাঁকে রংপুর জিলা স্কুল হতে বহিস্কার করা হয়। 

এরপর তিনি রংপুরের কৈলাস রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময় জীতেন্দ্রনারায়ণ রায়, অবিনাশ চক্রবর্তী, ঈশান চন্দ্র চক্রবর্তী সহ অন্যান্য বিপ্লবীর সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়, এবং তিনি বিপ্লবী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

১৯০৬ সালে কলকাতার বিপ্লবী নেতা বারীন ঘোষ প্রফুল্ল চাকীকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। যেখানে প্রফুল্ল দলে যোগ দেন। তাঁর প্রথম দায়িত্ব ছিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলারকে (১৮৫৪-১৯৩৫) হত্যা করা। কিন্তু এই পরিকল্পনা সফল হয় নাই। এর পর প্রফুল্ল চাকী ক্ষুদিরাম বসুর সাথে কলকাতা প্রেসিডেন্সি ও পরে বিহারের মুজাফফরপুরের অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল কিংসফোর্ডের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাকে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যা বেলায় হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। ইউরোপিয়ান ক্লাবের প্রবেশদ্বারে তাঁরা কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ির জন্য ওঁত পেতে থাকেন। একটি গাড়ি আসতে দেখে তাঁরা বোমা নিক্ষেপ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ গাড়িতে কিংসফোর্ডের ছিলেন না, বরং দুইজন ব্রিটিশ মহিলা মারা যান তারা ছিলেন ভারতপ্রেমীক ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা। প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম তখনই ঐ এলাকা ত্যাগ করেন।


প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম আলাদা পথে পালাবার সিদ্ধান্ত নেন। প্রফুল্ল ছদ্মবেশে ট্রেনে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২ মে ১৯০৮ সালে  ট্রেনে নন্দলাল ব্যানার্জী নামে এক পুলিশ দারোগা সমস্তিপুর রেল স্টেশনের কাছে প্রফুল্লকে সন্দেহ করেন। মোকামা স্টেশনে পুলিশের সম্মুখীন হয়ে প্রফুল্ল পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোণঠাসা হয়ে পড়ে তিনি ধরা দেওয়ার বদলে আত্মাহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজের মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। পরবর্তীতে অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেননি, তাকে পুলিশ খুন করে মাথা কেটে নেয়।