লকডাউন থেমে গেলে হয়তো ভাল দামে বেচা যাবে। এমন চিন্তায় পাখা তৈরি করছেন মা-ছেলে। ছবি-মামুনুর রশিদ
দেশের গ্রামীণ মেলার পণ্য তালপাতার পাখা বেচতে না পেরে বগুড়ার কাহালু উপজেলা দুটি গ্রাম ধুঁকছে। লকডাউনের কারণে গ্রাম দুটির কারিগদের তৈরি হাত পাখাগুলো আটকে আছে ঘরে। এতে তাদের লাখ লাখ টাকা লোকসানে পড়তে হয়েছে।
গত বছর থেকে করোনা শুরু হওয়ার পরেই থমকে পরেছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা। করোনায় গত দুই বৈশাখীসহ অন্যান্য মেলা বন্ধ হওয়া, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে কারিগরদের লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। সর্বশেষ এবারের লকডাউনে তারা একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
গ্রামের কারিগর ও ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, শত বছরের পুরোনো আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রামে প্রায় ৭০ ঘর বসতি রয়েছে। বছরে প্রতিটি ঘর গড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকার তালপাতার পাখা বিক্রি করেন। এতে গড়ে প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার পাখার ব্যবসায় হয় এ গ্রাম দুটিতে।
কিন্তু করোনার কারণে এক বছরে তাদের বিক্রি অর্ধেক কমে গেছে। এই হিসেবে এই গ্রামে অন্তত ৫০ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পরেছেন পাখা গ্রামের কারিগরেরা।
তালপাতার পাখার গ্রীষ্মের শুরুতে ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামে পাখার বিক্রির ধুম পড়ে যায়। কিন্তু করোনার কারণে বাইরের পাইকারী ব্যবসায়ীরা আসছেন না। আবার লকডাউনের কারণে কারিগররা বাইরে এসব পাখা সরবরাহ করতে পারছেন না। অনেকে সংসারের খরচ মিটাতে লোকসান দিয়ে পাখা বিক্রি করছেন।
তালপাতার পাখা তৈরির মৌসুম শুরু হয় অগ্রহায়ণে। চলে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। কিন্তু গত বছরের করোনার ধাক্কায় অধিকাংশরা মূলধন সংকটে ছিলেন। তারপরও চলতি মৌসুমে অর্থ লগ্নি করে তারা পৌষ মাস থেকে পাখা তৈরি শুরু করেন। তবে বিক্রির মূল সময় পহেলা বৈশাখের আগেই ব্যবসায় ধরা খেতে হয়।
কারিগররা জানান, প্রথমদিকে কিছু পাখা তারা সরবরাহ করেছেন। লকডাউন দেয়ায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মাল পাঠানো অসম্ভব হয়ে পরে। আবার মহাজনরা মাল কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এর মধ্যেও নিরুপায় অনেক কারিগর কম মূল্যে পাখা বিক্রি করছেন। এই বিক্রির মধ্যে মধ্যে পকেট পাখাই বেশি। মহাজনদের কাছে মাল পাঠাচ্ছেন নিজেদের খরচে, তাতেও পরিবহন ব্যয় বেশি দেয়া লাগছে। মূলধন ফেরত পাওয়ার আসায় ওই কারিগররা লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০০ পিস ঘুরকি পাখার বর্তমান দাম ৯০০ টাকা। ডাট পাখা দুই হাজার টাকা এবং পকেট পাখা ৩০০ টাকা।
সরেজমিনে আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রামে দেখা যায়, এখানকার প্রায় সব বয়সের মানুষ পাখা তৈরির কাজ করেন। অধিকাংশ ঘরগুলোয় নারী পুরুষ একসাথে বসে কাজ করছেন। কেউ পাতা কাটছেন, কেউ বাধছেন। অনেকে পাখায় রঙ করছেন। কিন্তু এর মধ্যেও কারিগরদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। অনাগত দিনের শঙ্কায় তারা দিনযাপন করছেন।
আড়োলা উত্তরপাড়ার কারিগর মজিবর রহমান আকন্দ (৮১) শুধু পাখা তৈরি করেই সংসার চালান। প্রতি বছর ৯ থেকে ১০ হাজার পিস ঘুরকি পাখা বানাতে পারেন তিনি। প্রতি পিস পাখা গড়ে ১০ টাকা দরে বিক্রি করতেন। এতে তার এক লাখ টাকা আয় হয় প্রতি বছর। কিন্তু গেল বছর করোনায় ৭০ হাজার টাকার পাখা বিক্রি করেন। তাতে লাভের অর্ধেক অংশ হারাতে হয়েছে তাকে।
মজিবর বলেন, ‘যত গরম হয়, পাখার চাহিদা তত বাড়ে। কিন্তু করোনা ও লকডাউনের কারণে এই তত্ব কাজে লাগছে না। পাখার বাজার একেবারে পরে গেছে। এ বছর একশ পিস ঘুরকি পাখার বাজার দর ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা। লকডাউন দেয়ার সাথেই দাম কমে গেল ২০০ টাকা। যাদের টাকা খুব দরকার তারাই বিক্রি করছেন।’
পাড়ার ছোট একজন কারিগর মোহাম্মদ সিরাজ জানান, ঘুরকি পাখার জন্য এক হাজার পিস কাঁচা পাতা কিনতে হয়েছে দেড় হাজার টাকায়। দু বছর আগে দাম ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ৩০ টাকার বাঁশ ৮০ টাকা। পাইপের চুঙ্গি কিনতাম ১৭ টাকা, এখন কেনা লাগছে ২৭ টাকা। এসব বিনিয়োগ করে প্রতি পাখা ১০ টাকায় বিক্রি করলে ৪ টাকা লাভ থাকে। কিন্তু শ্রমের মূল্য থাকে না।
সিরাজ বলেন, গতবারে লোকসান হওয়ার পর এবার ব্যবসা করতে পারতাম না। মহাজন অগ্রীম কিছু টাকা দেয়ায় পাখা বানাইছি। কিন্তু লকডাউনে পাখার দাম তো কমে গেছে। একশ পিস পাখার দাম ৯০০ টাকা। তাও কিনছে না মহাজন। এখন ধান কাটার কাজ শুরু হলে সংসার চালানোর খরচ উঠবে।
সিরাজের বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ি। তার স্ত্রী ফাতেমা পাখার চাক কাচি দিয়ে কাটছেন। জানালেন, পাখা অনেক জমে আছে। বেচা যাচ্ছে না। তার স্বামী গাড়িতে পাঠানোর খোঁঁজ নিতে গেছেন।
তারপরও পাখা বানাচ্ছেন এমন প্রশ্নে ফাতেমা বলেন, পারিবারিক পেশা তাই বন্ধ রাখতে পারি না। আর পাতা কেনা হয়েছে। এ জন্য পাখা তৈরি করে রাখছি।
মুঠোফোনে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দুই হাজার পিস পাখা আটকে আছে। পাঠাতে পারছি না। মহাজন বলছেন নিজের খরচে পাঠাতে হবে। সেটার খোঁজ নিয়ে শুনি আগে যেখানে লাগত এক হাজার টাকা, এখন পরিবহন ব্যয় লাগবে দুই হাজার টাকা। তাই চলে আসছি।
উত্তর পাড়ার পাকা রাস্তার পশ্চিমে কয়েক বাড়িতে ডাট পাখা তৈরি হয়। সেখানে বাড়ির সামনে পুকুরের পাড়ে ছাউনি দেয়া বৈঠক ঘর। পাঁচ জন বয়স্ক নারী ও পুরুষ বসে রয়েছেন। একজন পুকুরের পানিতে পাখা পরিষ্কার করছেন। সামনের দিনের দুরাবস্থা নিয়েই কথা বলছিলেন তারা। জানা গেল প্রত্যেকের বাড়িতে পাখা মজুত হয়ে আছে। কারও দু হাজার, তো কারও চার হাজার পিস।
এদের মধ্যে বাদশা মিয়ার স্ত্রী হাফিজা বলেন, গত বছর করোনায় লোকসান হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এবার পৌষ মাসে পাখা বানানো শুরু করলাম। তিন হাজার পিস পাতা কেনা হয়েছে। তবে দুই টাকার প্রতি পিস তালপাতা এবার কিনেছি ছয় টাকায়। কিন্তু পাখা বিক্রি করেছি মাত্র ৯০০টি।
পাশের আরেক কারিগর নুর বানু বলেন, ১১ হাজার টাকা মহাজন অগ্রিম দিয়েছিল। তাতে পাখা বানানো শুরু করি। কিন্তু আগের দুই হাজার পিস পাখা ঘরে পরে আছে। কবে বেচা হবে কিছুই জানি না।
একই অবস্থা আব্দুল বাছেদেরও। কারিগরদের মূল সমস্যার বিষয়ে বললেন, আমরা সবাই দিন এনে দিন খাই। মৌসুমের ব্যবসা না হলেই আমাদের ক্ষতি। এখনকার যে টাকা আটকে গেল এটা আর পূরণ করতে পারি না।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার বাসিন্দা পাখার মহাজন মজিবরের সাথে মুঠোফোনে কথা হয়। জানালেন গত বছর ৬০ হাজার টাকার পাখা কিনেছিলেন। এরপর ব্যবসা করতে পারেননি। লোকসান হয় ৩০ হাজার টাকা। এবার করোনা পরিস্থিতি ভালো দেখে পাখা কিনেছিলেন ১৭ হাজার টাকার। এতে লোকসান হয়েছে তিন হাজার টাকা। এ জন্য পাখা কেনা বন্ধ করে দিছি। কারন বেচার জায়গাই তো নেই।
মজিবর বলেন, পাখা বিক্রির সময় গরমকাল। আর দেশের বিভিন্ন স্থানের মেলা। কিন্তু করোনার কারনে তা থেকে আমরা বঞ্চিত। পাইকারী ব্যবসায়ীদের মত আড়োলা ও যোগীর ভবন গ্রামের প্রত্যেক কারিগরই গড়ে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লোকসানে রয়েছেন।
গ্রাম দুটি পাইকড় ইউনিয়নের অন্তর্গত। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিটু চৌধুরী বলেন আড়োলা ও যোগীর ভবন গ্রামের প্রায় ৭০ ঘরে তালপাতার পাখা তৈরি হয়। প্রতিবছর ২ থেকে ৪ লাখ পিস পাখা তারা তৈরি করেন। যা দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়।
মিটু চৌধুরী বলেন, করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে লকডাউন দেয়ার পর দুই গ্রামের পাখার কারিগররা একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় বিভিন্ন সহায়তা তাদের দেয়া হয়েছে। আগামীতে সুযোগ আসলেই তাদের দেয়ার চেষ্টা করা হবে।