Joy Jugantor | online newspaper

নীলফামারীতে গরুর অভাবে নিজেরাই ঘানি টানেন বৃদ্ধ দম্পতি

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নীলফামারীতে গরুর অভাবে নিজেরাই ঘানি টানেন বৃদ্ধ দম্পতি

নীলফামারীতে গরুর অভাবে নিজেরাই ঘানি টানেন বৃদ্ধ দম্পতি

বাংলা চলচ্চিত্র ‘ঘানি’তে আমরা দেখেছি এক গরিব মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম। যেখানে জীবিকার টানে বুকের জোরেই চালাতে হয় ঘানি। পর্দার সেই কাহিনি ছিল এক শিল্পিত নির্মাণ। কিন্তু নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি পাগলাটারি গ্রামের মোস্তাকিন আলীর জীবন যেন সেই সিনেমার বাস্তবরূপ। পার্থক্য শুধু, তার কাহিনি কোনো পরিচালক ক্যামেরাবন্দি করেননি। এটি লিখেছে বাস্তবের কঠিন জীবন।

৬৫ বছর বয়সে এসে হাঁপ ধরা শরীর আর টান সামলায় না। তবুও মোস্তাকিন থামেননি। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে সংসার চালাতে তিনি বুক ঠেকিয়ে টেনে চলেছেন কাঠের ঘানি। কখনোই গরু কেনার সামর্থ্য হয়নি তার, তাই শরীরকেই বানিয়েছেন বলদের বিকল্প। পাশে আছেন তার স্ত্রী ছকিনা বেগম। দুজনে মিলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বেঁচে আছেন ঘামের বিনিময়ে।

প্রতিদিন ভোরে মোস্তাকিন আলীর দিন শুরু হয় সরিষা সংগ্রহ দিয়ে। আশপাশের গ্রাম ঘুরে ৭০ টাকা কেজি দরে সরিষা কিনে আনেন। দুপুরে ঘরে ফিরেই টানতে শুরু করেন ঘানি। কাঠের চাকায় সরিষা ভেঙে বের হয় তেল, আর ফেলে রাখা খৈল হয় গরুর খাবার। দিনে প্রায় পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙেন, তাতে মেলে মাত্র সোয়া লিটার তেল ও তিন কেজির মতো খৈল। বিকেলে বাজারে তেল বিক্রি করে হাতে আসে দুই থেকে আড়াইশ টাকা। এই অল্প টাকাতেই চলে তাদের সংসার, তিনবেলা ভাত, ওষুধ। তাদের ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নেই।

‘ঘানি’ চলচ্চিত্রে যেমন দেখা যায়, দারিদ্র্যের চাপে চরিত্ররা লড়াই করে যায়, মোস্তাকিনের জীবনও তেমন। জোড়াতালি দেওয়া টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে, বৃষ্টি নামলে ঘরে চুইয়ে পড়ে পানি। অথচ তিন দশকের বেশি সময় ধরে টিকে থাকার একমাত্র ভরসা এই ঘানি।নিজের কণ্ঠেই তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঘানি টানতাম। তারপর থেকে একটানা ৩৫ বছর ধরে এভাবেই সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বয়সের কারণে শরীর আর সায় দেয় না। হাঁপিয়ে যাই। যদি একটা গরু থাকত, তাহলে গরু দিয়েই ঘানি চালাতে পারতাম। কিন্তু সে সাধ্য নেই।’

স্ত্রী ছকিনা বেগমের কণ্ঠেও একই হাহাকার, ‘বিয়ের পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আমিও বুক দিয়ে ঘানি টানি। এখন বয়স হয়েছে, শরীর আর আগের মতো শক্তি নেই। অনেক সময় তিনবেলা খাওয়াই জোটে না। একটা গরু পেলে কষ্টটা অনেকটাই কমতো।’স্থানীয়রা জানালেন, বহু বছর ধরে এ দম্পতিকে এভাবেই ঘানি টেনে বাঁচতে দেখেছেন। প্রতিবেশী মিজানুর রহমান বললেন, ‘আমাদের এলাকায় সবচেয়ে অভাবী পরিবার এরা। মাঝে মাঝে আমরা সাহায্য করি, কিন্তু যদি একটা গরু কেউ দিত, তাহলে তাদের জীবন পাল্টে যেত।’

এমন বাস্তব কাহিনির পাশে দাঁড়াতে চায় স্থানীয় প্রশাসনও। কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রীতম সাহা বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে খুব দ্রুতই তাদের সরকারি সুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা করব।’পর্দায় দেখা ‘ঘানি’ হয়তো ছিল রূপক, কিন্তু মোস্তাকিন আলীর গল্প নিছক কোনো কাহিনি নয়। এটি জীবনের নিরেট সত্য। যে সত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেয়, দারিদ্র্যের ভার বইতে হয় বুকের জোরে, আর মানবিক সহায়তার স্পর্শই পারে, সেই কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে।