তাজমা সিরামিক কারখানা। ছবি: জয়যুগান্তর
৬৩ বছর আগে উত্তরের পিছিয়ে পড়া জনপদে কতোটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে সিরামিক কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল তা এখন অনেকেরই কল্পনার অতীত। ওই সময়ে শুধু ঢাকা যেতেই বগুড়ার মানুষকে অন্তত ৮ বার ফেরিতে পার হতে হতো।
এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, এই কারখানায় চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল আনতে কী ভোগান্তিই না পোহাতে হয়েছে! অদম্য শক্তি নিয়ে তবুও এগিয়ে চলেছে এই শিল্প প্রতিষ্ঠান। পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন সংকট কাটিয়ে দেশের প্রথম এই সিরামিক কারখানা সম্ভবনাময় শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
অদম্য এই কারখানার নাম ‘তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড’। তিন একর জমিতে ৫০ জন শ্রমিক নিয়ে বগুড়ার কলোনী এলাকায় ১৯৫৯ সালে এই কারখানা গড়ে ওঠে। শুধু তৈজসপত্র তৈরির বিশেষায়িত এই কারখানার মাধ্যমে এদেশে আধুনিক সিরামিক শিল্পের যাত্রা হয়।
শুরুতে এখানে তিন থেকে চার ধরনের কাপ তৈরি হলেও এখন অন্তত ৭০ রকমের তৈজসপত্র উৎপাদন করা হয়। আর কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ২৩০ জন মানুষের; যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী। যাদের হাতের ছোঁয়ায় প্রতিদিন প্রায় ৪ টন পণ্য তৈরি হচ্ছে। এসবের চাহিদা দেশের সব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে রয়েছে। এখানে কাজ করে অনেক নারী জীবনের গতিপথ খুঁজে পেয়েছেন।
তাদের মধ্যে একজন হলেন বগুড়ার ধুনট উপজেলার সেবেকা বেগম। তার স্বামী লাইজু মারা যাওয়ার পর ১৩ বছর ধরে এখানে প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এখানে কাজ করেই এক মেয়ে নাসরিক আক্তারকে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অনার্সে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
গাবতলীর হালিমা বেগম তাজমা সিরামিকে কাজ করে তার তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তার স্বামী আফতাব আলী বাসচালক। এই সংসারে তিনিও এখন খরচ দিচ্ছেন। ১২ বছর ধরে এখানে কাজ করা এই নারী এখন প্রতিদিন ২৫০ টাকা বেতন পাচ্ছেন।
তাজমা সিরামিক কারখানা সূত্রে জানা গেছে, মরহুম মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার এই কারখানার স্বপ্নদ্রষ্টা। তার হাত ধরেই এই কারখানা বিকশিত হয়ে আজকের আধুনিক জগতে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান আমলে তৈরি হওয়া এই কারখানার পেছনেও অনেক সংগ্রাম রয়েছে। ১৯৫৯ সালে কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেন আব্দুল জব্বার। এক বছর পরে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যায়। তখন এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন আব্দুল জব্বার। আর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তার আপন তিন ভাই তাজিমুদ্দিন, মজিবর রহমান ও আমজাদ হোসেন তাজমা।
১৯৮৫ সালে জব্বারের মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন আমজাদ হোসেন ওরফে তাজমা। তিনিও বেঁচে নেই আর। ২০২০ সালে মারা যান তাজমা। এরপর এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন জব্বারের একমাত্র ছেলে মো. শরিফুজ্জামান।
তাজমা সিরামিকে এখন তিনজন পরিচালক রয়েছেন। জব্বারের জামাই মো. শাহাজান আলী, শরিফুজ্জামান ও তার চাচাতো ভাই মতিউর রহমান। আমজাদ হোসেনের মৃত্যুর পর শরিফুজ্জামান প্রতিষ্ঠানে যুগ্ম ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
পাঁচ যুগ আগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সিরামিকের মতো কারখানা কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানে বসেই কথা হয় শরিফুজ্জামানের সাথে। বলেন, তাদের দাদাবাড়ি নওগাঁর রানীনগরে। পাকিস্তান আমলে তার বাবা বগুড়ায় এসে একটি বিড়ি কারখানায় চাকরি করেন। এরপর তিনি নিজেই বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন পাকিস্তান আমলে। বিড়ি ব্যবসার মূলধন থেকে সিরামিক কারখানা গড়ার পরিকল্পনা করেন তার বাবা আব্দুল জব্বার। ১৯৫৯ সালে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিচিম্যান ট্রেডিং হাউজিংয়ের সহায়তার তাজমা সিরামিক প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় জাপানি প্রকৌশলীরা বগুড়ায় অবস্থান করে কোম্পানি পরিচালনা করেন। উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও সহায়তা করেন। তখন বাংলাদেশি শ্রমিক আর জাপানি প্রকৌশলী মিলে ফার্নেস ওয়েল দিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখে। কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে কারখানার তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা বাড়ে।
চাহিদার প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রেক্ষাপটে ১৯৬২ সালে গড়ে তোলা হয় পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি উৎপাদনে যায় ১৯৬৬ সালে। তবে স্বাধীনতার পর কোম্পানিটির নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ। এরপর থেকে দেশে তাজমা ও পিপলস সিরামিক কারখানা রাজত্ব করে আসে। কিন্তু এই সময় কিছুটা সংকটে পড়ে তাজমা সিরামিক। কারণ ওই সময় আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আসে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ। পরে তারা গ্যাস সংযোগও পায়।
শরিফুজ্জামান বলেন, পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ আসার পর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ও গ্যাসের সহায়তার সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য তৈরি করতে পারে। এরপর বিষয়টি মাথায় নিয়ে বাজারে টিকে থাকার তাগিদে তাজমা সিরামিক আধুনিকায়ন করা হয় ১৯৮০ সালে। তবে গ্যাস না থাকার সংকট রয়ে-ই যায়। কিন্তু এর মধ্যে সরকার অবশ্য মফস্বলে গড়ে ওঠা কারখানায় ফার্নেস ওয়েলের জন্য বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করে। কিন্তু ২০০১ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে ফার্নেস ওয়েল থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়।
ওই সময় তাজমায় প্রতিদিন সাড়ে ৬ হাজার ফার্নেস ওয়েল লাগতো। এবং ফার্নেস ওয়েলের দামের কারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে ২০০১ সালেই তাজমা সিরামিকের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। এভাবেই বন্ধ থাকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়েই প্রতিষ্ঠানটি একটি ব্যাংকের ২ দশমিক ৭৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপীতে পরিণত হয়। বড় অংকের এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এরপর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গ্যাস সংযোগ পেলে আবারও উৎপাদনে যায় এই শিল্প কারখানা।
শরিফুজ্জামান জানান, গ্যাস সংযোগের পর ফের নতুন উদ্যোমে কারখানা চালু হয়। নতুন করে উৎপাদনের যাওয়ার চার বছরের মাথায় তাজমা সিরামিক ব্যাংক ঋণের পুরো টাকা অর্থাৎ ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে। এখন এই প্রতিষ্ঠানের আর কোনো ব্যাংকের কাছে ঋণ নেই। প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়েই চলে কারখানা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, স্বাধীনতার পর দশে ১৯৮৬ সালে বেঙ্গল ফাইন সিরামিক লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো বেশ কয়েকটি সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) হিসাবে দেশে সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানা আছে ৬৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের জন্য দেশীয় সিরামিক শিল্প পুরোটাই আমদানিনির্ভর। জাপান, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, বুলগেরিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সংগ্রহ করে থাকে কোম্পানিগুলো।
বতর্মানে দেশের সিরামিক শিল্পের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। বিসিএমইএ এর তথ্য বলছে, এক সময় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর থাকলেও বর্তমানে এ শিল্প অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানিমুখীও হয়ে উঠেছে। দেশে স্থাপিত সিরামিক শিল্প-কারখানাগুলোয় উৎপাদিত পণ্য মূলত তিন ভাগে বিভক্ত স্যানিটারিওয়্যার, টেবিলওয়্যার ও টাইলস। এর মধ্যে স্যানিটারিওয়্যার তৈরি করে ১০ টি প্রতিষ্ঠান। টেবিলওয়্যার তৈরি করে ২০টি। বাকি ৩০টি প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় টাইলস। এর মধ্যে টেবিলওয়্যার বা তৈজসপত্র উৎপাদনের সাথে দেশে তাজমা সিরামিক, মুন্নু সিরামিক, শাইনপুকুর, প্রতীক, প্যারাগন, স্টার, আকিজসহ অন্তত বড় ১০ টি প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে।
যুগ্ম ব্যবস্থাপক মো. শরিফুজ্জামান বলেন, ‘বগুড়ার তাজমা সিরামিকে বছরে অন্তত ১১ হাজারের বেশি পণ্য এখানে উৎপাদিত হয়। গড়ে উৎপাদন প্রায় দেড় হাজার টন তৈজসপত্র। পণ্যগুলোর মধ্যে প্লেট, কাপ, গ্লাস, জগ, মগ, বাটি, স্যুপবাটি সেট, ফুলদানি, শো-পিস উল্লেখযোগ্য। প্রতি মাসে বিক্রি হয় প্রায় ১ কোটি টাকার পণ্য। বর্তমানে তাজমা সিরামিকের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।’
কিন্তু সাম্প্রতিককালের চলমান লোডশেডিংয়ে উৎপাদন, পরিবহন খরচ বেড়ে সিরামিক ব্যবসাও দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তাজমার এই যুগ্ম ব্যবস্থাপক। তবে এই শিল্প বিকশিত হলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। এক সময় সংকটে পড়া দেশের প্রথম এই সিরামিক কারখানা এখন সম্ভবনাময় শক্তিতে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন শরিফুজ্জামান।