Joy Jugantor | online newspaper

বগুড়া

১০ কোটি টাকায় নির্মিত ৩ হাসপাতাল ১৫ বছরেও চালু হয়নি

খোরশেদ আলম

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ০৯:২৪, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

১০ কোটি টাকায় নির্মিত ৩ হাসপাতাল ১৫ বছরেও চালু হয়নি

নন্দীগ্রামে অবস্থিত ২০ শয্যার হাসপাতাল। ছবি- জয়যুগান্তর

বগুড়ায় ১৫ বছর আগে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালগুলো এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। অথচ হাসপাতালের লাখ লাখ টাকার টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতাল সচলের 'উপায় নেই' মন্তব্য করে সিভিল সার্জন কার্যালয়ও সরকারি সম্পদ নষ্ট হওয়ার বিষয়টি নীরব দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছে।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করা হয় ২০০২ সালে। নির্মাণ কাজ শেষ হয় তড়িঘড়ি করেই। উদ্বোধন করা হয় ২০০৬ সালে। নির্মাণ ব্যয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। নির্মাণ কাজ আর যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও ১৫ বছর ধরে চালু করা হয়নি এই হাসপাতাল।

শুধু এটিই নয়, প্রায় একই সময়ে নির্মিত জেলার ২০ শয্যা বিশিষ্ট আরও দুটি হাসপাতালেরও একই অবস্থা।

জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নন্দীগ্রাম হাসপাতাল নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৮ টাকা। প্রায় একই সময়ে বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহারে ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই হাসপাতালের প্রাথমিকভাবে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৮ টাকা। নির্মাণ কাজ পায় ঢাকার কোম্পানি কিট-ওয়ে প্যাক। তবে কাজ শেষ না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লাপাত্তা হয়ে যায়। আর শিবগঞ্জ উপজেলার আলীয়ারহাট হাসপাতালের নির্মাণ ব্যয় ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

তবে এই বিশাল টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব হাসপাতাল এখনো চালু করতে পারেনি প্রশাসন। কারণ হিসেবে জনবল সংকটকে দায়ী করা হয়েছে। আলাদা কোনো ওষুধও বরাদ্দ নেই এসব হাসপাতালের জন্য। ফলে হাসপাতালগুলো থেকে এলাকার মানুষ কোনো সেবা পাচ্ছেন না। চিকিৎসক কিংবা সেবিকা-সেবক তো নেই।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় বলছে, নন্দীগ্রাম হাসপাতালের জন্য ২০০৮ সালে ১৮টি পদ সৃষ্টি করা হয়। এরমধ্যে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, ৬ জন চিকিৎসক, ৫ জন সেবিকা, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন ল্যাব সহকারী। চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ শিবগঞ্জের আলীয়ারহাট হাসপাতালের জন্য ১১ জনকে পদায়ন করা হয়। সান্তাহারেও কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়। তবে পরিচ্ছন্নকর্মী, পিয়ন, আয়া, ওষুধ বরাদ্দ না থাকাসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে তাদের সেখানে রাখা সম্ভব হয়নি। পরে পদায়ান পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।

সম্প্রতি নন্দীগ্রামের ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক আর নিচ তলার কয়েকটি কক্ষ খোলা রয়েছে। নিরাপত্তাকর্মী কিংবা নৈশপ্রহরী নেই। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার বিছানা ও আসবাবপত্রের কোনো খোঁজ নেই। বৈদ্যুতিক বাতিগুলো চুরি হয়েছে। ভবনের দরজা-জানালায় ঘুণপোকার বাসা। এতে অনেক দরজা-জানালার কপাট খুলে পড়ছে। মেঝেতে ধুলির আস্তরণ। দেওয়ালেও শ্যাওলা ধরে গেছে। ভুতুরে সিঁড়ি। অপারেশন থিয়েটারের পড়ে আছে ভাঙা যন্ত্রপাতি। অপারেশন থিয়েটারের সামনেই ময়লায় স্তূপ। আর হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য তৈরি ভবনগুলো জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, এই জঙ্গলের মধ্যে মাদকসেবীরা এসে মাদক গ্রহণ করে।

নন্দীগ্রামের এ হাসপাতালের নিচ তলায় দুটি কক্ষে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উপজেলায় তাদের অবকাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ বলে এখানে সপ্তাহে একদিন নারীদের জন্মবিরতিকরণ অপারেশন করা হয়।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসক মুশফিকুর রহমান এই হাসপাতালে চিকিৎসা করছিলেন। তিনি বলেন, 'ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা বেহালের কারণে এখানে নারীদের জন্মবিরতিকরণ অপারেশন করা হয়। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে মাসে ৭০-৮০ টি অপারেশন করা করা হয়।'

এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নন্দীগ্রামের ৩১ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বিজরুল বাজারে। এ কারণে উপজেলা সদরে একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের। এই দাবির প্রেক্ষিতে উপজেলা সদরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এই হাসপাতালে চলছে ইউনিয়ন উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আদলে প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম। ওই কার্যক্রমের উপ সহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানান, তারা এখানকার নিয়োগপ্রাপ্ত নন। প্রেষণে তাদের এখানে পাঠানো হয়েছে।

কর্মরত উপ সহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা উম্মে হাসনা বানু বলেন, 'এক সময় এখানে প্রতিদিন ২০০ রোগী আসতেন। কিন্তু এখন গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো সেবা দেওয়া যায় না।'

নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন মণ্ডল জানান, 'তারা দুজন উপজেলার চিকিৎসক। তাদের অফিসে সংস্কার কাজ চলছে। এ কারণে ওই হাসপাতালে অফিস করছেন। অথচ লোকবলের অভাবে হাসপাতালেই নষ্ট হচ্ছে অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি, এয়ার কন্ডিশনসহ আরও অনেক কিছু।'

নন্দীগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুল হাসান সিদ্দিকী বলেন, 'জনগণের সেবার জন্য অত্যাধুনিক এই হাসপাতাল চালু হওয়া খুব জরুরি।'

সাবেক মেয়র সুশান্ত কুমার বলেন, 'এই হাসপাতাল চালু হলে কাহালু ও নন্দীগ্রাম মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ উপকৃত হবে। সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকিগুলোও চালু করেছে। জনগণ সেবা পাচ্ছে। অথচ অজ্ঞাত কারণে এই হাসপাতাল চালু হচ্ছে না।'

অন্যদিকে, আলীয়ারহাট হাসপাতালের অবস্থান উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। বগুড়া শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এখানে একজন উপ সহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। তাদের প্রেষণে রাখা হয়েছে। কিছু লোকজনকে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তবে এখানকার হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রয়েছে। এখানে একজন নিরাপত্তাকর্মীও রয়েছেন।

সান্তাহার পৌরসভাসহ আশপাশের লক্ষাধিক মানুষের জন্য শহরে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল নেই। চিকিৎসার জন্য এই এলাকার মানুষকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নওগাঁ সদর হাসপাতাল অথবা প্রায় আট কিলোমিটার দূরে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। কিন্তু সান্তাহার হাসপাতালের নির্মাণ কাজই এখনো শেষ হয়নি।

বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান তুহীন বলেন, '২০ শয্যা বিশিষ্ট তিন হাসপাতালের একই অবস্থা। জনবল নেই। হাসপাতালেই নষ্ট হচ্ছে অপারেশন থিয়েটারের লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি। সরকার শুধু ভবন আর যন্ত্রপাতি দিয়েছে, কোনো লোকবল দেয়নি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। লোকবলের জন্য আমরা বার বার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছি। কাজ হয়নি। ফলে ১৫ বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট না হওয়ার কোনো কারণ নেই।'