Joy Jugantor | online newspaper

বগুড়ায় এনআইডি জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতার হিড়িক

খোরশেদ আলম

প্রকাশিত: ১৩:৪০, ১০ আগস্ট ২০২০

আপডেট: ১৩:০৬, ১২ জুলাই ২০২১

বগুড়ায় এনআইডি জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতার হিড়িক

বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় মহিষাবান ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের আপন বোন মোছা. লুতফন নেছার বাড়ি সাত নম্বর ওয়ার্ডে। ২০১৬ সালের জাতীয় পরিচয়পত্র মতে, তার বয়স ৫০ বছর। অথচ বয়স্ক ভাতার কার্ডে তার বয়স দেখানো হয়েছে ৬৬। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তিনি সরকারি টাকা তুলে নিচ্ছেন কয়েক বছর ধরে।

কেবল লুতফুন নেছা নয়, এভাবে বয়স জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতা নিচ্ছেন ইউপি সদস্যদের বাবাসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। দৈনিক জয়যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যরা দাবি করছেন, ‘এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না। জালিয়াতির বিষয়টিও তাদের আওতার বাহিরে।’

সরকারের বয়স্ক ভাতার বিষয়টি দেখাশোনা করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। বয়স জালিয়াতির বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ও দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বলছেন, ইউপি চেয়ারম্যান ভাতা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব চেয়ারম্যানের। সব কিছু এভাবে উপজেলার পক্ষে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা (সংশোধিক) ২০১৩ অনুযায়ী, দেশের বয়স্ক, স্বল্প উপার্জন অথবা উপর্জনে অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা সুদৃরকরণ এবং ভরণ-পোষণের লক্ষে সরকার এই কর্মসূচি  চালু করে। এই ভাতা পেতে হলে পুরুষের বসয় সর্বনিম্ন ৬৫ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৬২ বছর হতে হবে।

জয়যুগান্তরের অনুসন্ধান বলছে, ২০১৭-২০১৮ অর্ধ বছরে মহিষাবান ইউনিয়নের ৫০ জনেরও বেশি নারী পুরুষ তাদের বয়স জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতা নিয়েছেন। অনেকের বয়স ৫০ বছর তারাও ভাতা পাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই জালিয়াতিতে সহায়ক ভূমিকায় রয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান নিজেই।

ইউপির এক নম্বর ওয়ার্ডের সোনাকানিয়ার বাসিন্দা লাইলি বেগম। তার স্বামীর নাম দিলবর। ২০১৬ সালের ভোটার তালিকা মতে লাইলির জন্ম ৫ মে ১৯৬৩। এ হিসেবে ১ জুলাই ২০১৭ সালে তার বসয় হয় ৫৪ বছর এক মাস। অথচ তিনি বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। বয়স্ক ভাতার তালিকায় তিনি ৪ নম্বরে রয়েছেন। বয়স্ক ভাতায় তালিকায় জন্ম ১৫ মার্চ ১৯৫৩ সাল দেখানো হয়েছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্বাসের ছেলে আব্দুল কুদ্দুস। ভোটার তালিকায় অনুযায়ী তার বয়স ৬২ বছর পাঁচ মাস। তিনি পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা। বয়স দেখানো হয়েছে ৮০ বছর। বয়স্ক ভাতা নম্বর ৫। তিনি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান-৩ জাহাঙ্গীর আলমের বাবা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম মোবাইলে জয়যুগান্তরকে বলেন, `আমি জন্ম নিবন্ধন দিয়ে এই কার্ড করেছি। সেখানে তার বয়স ৭২ বছর।  জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) বয়স কম রয়েছে। ভোটার আইডি কার্ডে বসয় ভুল রয়েছে।’

তিন নম্বর ওয়ার্ডের (নিশিন্দারা) আব্দুস সামাদ মোল্লার স্ত্রীর মোছা. হামিদুন খাতুনের বয়স ৫৭ বছর ৬ মাস। অথচ জালিয়াতি করে তার বয়স দেখানো হয়েছে ৬৬ বছর। তার বয়স্ক ভাতা নম্বর ১৬।

১৮ নম্বর বয়স্ক ভাতার তালিকায় জালিয়াতি করে নাম উঠিয়েছেন মোছা. সাহেরা খাতুন। কর্নিপাড়ার বাসিন্দা সাহেরার এনআইডি তালিকা মতে বয়স ৬০ বছর ১০ মাস। কিন্তু তিনি জালিয়াতি করে বয়স ৭৫ বয়স করে নিয়েছেন।

চার নম্বর ওয়ার্ডের (মড়িয়া) বাসিন্দা আব্দুল লতিফ। বয়স্ক ভাতার তালিকায় ২৭ নম্বরে রয়েছেন তিনি। এনআইডি অনুযায়ী তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর সাত মাস। কিন্তু জালিয়াতি করে বয়স বাড়িয়ে করে নেওয়া হয়েছে ৬৫ বছর। পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা।

একই গ্রামের মৃত জয়নাল মন্ডলের ছেলে জাফর আলীর নাম রয়েছে বয়স্ক ভাতার তালিকায় ২৯ নম্বরে। জাতীয় পরিচয়পত্র মতে তার বয়স ৬৪ বছর হলেও দেখানো হয়েছে ৬৭ বছর।

ওই গ্রামের হযরত আলীর স্ত্রী আঞ্জুমান আরা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ৬০ বছর বয়সেই! অথচ জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স জালিয়াতি করে তিনি ৬৬ বছর দেখিয়েছেন। তার বয়স্ক ভাতা তালিকায় নাম রয়েছে ৩২ নম্বরে।

ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রানীরপাড়ার বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেনর স্ত্রী শাহিনুর বেগম। জাতীয় পরিচয়পত্রের তার বয়স ৪৭ বছর থাকলে জালিয়াতি করে করা হয়েছে ৬৮ বছর। বয়স্ক ভাতার তালিকায় তার নাম ৩৩ নম্বরে রয়েছে।

একই গ্রামের মৃত লায়েব মন্ডলের ছেলে বয়স্ক ভাতা পান ৩৪ নম্বর তালিকা অনুসারে। তার বসয় ৪৫ বছর হলেও দেখানো হয়েছে ৬৬ বছর। ওই গ্রামের মৃত দিলবরের ছেলে বাসিন্দা মুনু প্রামাণিক। ৬৭ বছর বয়স দেখিয়ে বয়স্ক ভাতা নিলেও তার প্রকৃত বয়স ৬০। তিনি বয়স্ক ভাতার তালিকায় ৩৭ নম্বরে রয়েছেন।

ইউপি সদস্য সুলতানের বাবা মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনিও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতার কার্ড করেন। রানীরপাড়ার এই বাসিন্দার জন্ম ১৯৫৮ সালে। এ অনুযায়ী তার বষয় হয় ৫৯ বছর। অথচ বয়স্ক ভাতায় তার বয়স দেখানো হয়েছে ৬৯ বছর। বয়স্ক ভাতার তালিকায় তার নাম রয়েছে ৪১ নম্বরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিষাবান ইউনিয়নের সদস্য সুলতান বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে হবে।’

৬ নম্বর ওয়ার্ডের রানীর পাড়ার মৃত লাইমদ্দিনের ছেলে মো. আফছার ফকির বসয় ৬০ বছর। কিন্তু দেখানো হয়েছে ৭৬ বছর। তার কার্ড নম্বর ৪৭।

মহিষাবানের মৃত রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে মুছা মন্ডল ৬০ বছর বয়সেই বয়স্ক ভাতা পান। তবে ভাতার তথ্যে তিনি বয়স উল্লেখ করেছেন ৬৬ বছর। এমন বয়সে জালিয়াতি করে বসস্ক ভাতা নিচ্ছেন আট নম্বর ওয়ার্ডের আংগুর বেগম, আব্দুল লতিফ, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মকবুল পাইকার। এছাড়া আরও অনেকের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে বয়স্ক ভাতা নেওয়ার অভিযোগে রয়েছে।

বয়স্ক ভাতা পাওয়া ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর নতুন কার্ডেও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এক নম্বর ওয়ার্ডের (ধর্মগাছা) খলিলুর রহমান মারা যাওয়ার পর তার মেয়েকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র মতে তার বয়স ৫৭ বছর। অথচ জালিয়াতি করে তার বসয় দেখানো হয়েছে ৬১। বয়স্ক ভাতার তালিকায় তিনি ১ নম্বরে রয়েছেন।

সোনাকানিয়ার বাসিন্দা জরিনা বেগম মারা যাওয়ার পর বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় তার ভাই মো. আব্দুর রশিদকে। ৫৫ বছর বয়স হলে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ৬২ বছর করা হয়েছে।

এমন জালিয়াতির তালিকায় রয়েছেন সোনাকানিয়ার ফিরোজা বেগম, এক নম্বর ওয়ার্ডের ধোড়া এলাকার মৃত আবু তালেবের মেয়ে মোর্শেদা বেগম, তিন নম্বর ওয়ার্ডের গুঢ়টুপ নগরের রহিমুতুল্লাহ ফকিরের মেয়ে রওশন আরা বেগম, একই এলাকার জরিনা বিবির ছেলে বাচ্চু মিয়া, মোছা. কমলা বেগম, কর্নিপাড়া এলাকার মঞ্জিলা বেগম, নিশিন্দারা এলাকা জামেলা খাতুন, মড়িয়ার পাড়ার গ্রামের জমেলা বেগম, রিনা মজুমদার, জাবেদা বেগম, রানীরপাড়ার মৃত আকরাম মন্ডলের ছেলে মোহাম্মদ আলী, মৃত আক্কেল আলীর মেয়ে নুরভান বেগম, মৃত ছলেমান মন্ডলের ছেলে মো. আব্দুল প্রামাণিক, মৃত হাবিবর রহমানের মেয়ে আমেনা বিবি।

উপজেলা ত্রাণ কমিটির প্রতিনিধি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ওয়াজেদ আলী অভিযোগ করেন, ইউপি চেয়ারম্যান জালিয়াতি করে এভাবে অসংখ্য মানুষকে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। একেকটি কার্ড করে চেয়ারম্যান মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন।

২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বয়স্ক ভাতার চূড়ান্ত তালিকা স্বাক্ষর করেন গাবতলী উপজেরা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আব্দুল হান্নান সরকার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব তালিকা ইউনিয়ন কমিটি যাচাই-বাছাই করে শেষ সময়ে দেয়। তখন উপজেলা কমিটির এসব ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। মহিষাবান ইউনিয়নের সমস্যা অনেক আগের। এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পুরনো। রাষ্ট্র তাকে দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু তিনি যদি দুর্নীতি করেন তাহলে সেখানে আমাদের কী করার আছে!’

তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই-বাছাই করার সুযোগ ছিল না। বয়স জালিয়াতি করে ভাতা নেওয়ার সমস্যা পুরো বাংলাদেশে। এখন থেকে আর এমন সমস্যা হবে না।’

তবে অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বক্তব্য ভিন্ন। তিনি জয়যুগান্তরকে বলেন, ‘এই আইডি কার্ড যাছাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব উপজেলার কর্মকর্তাদের। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রওনক জাহান বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো হাতে পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুপারিশ করা হবে।’