Joy Jugantor | online newspaper

সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পে ধীরগতি

আব্বাস আলী

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২১ জানুয়ারি ২০২২

সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পে ধীরগতি

সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পে ধীরগতি।

নওগাঁর সীমান্তবর্তী উপজেলা সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পের নীতিগত অনুমোদনের সময় পেরিয়েছে দুই বছর। কিন্তু দৃশ্যমান কাজের অগ্রগতি করতে পারেনি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ করতে জেলা প্রশাসন থেকে সম্ভাব্য ব্যয় পাঠানো হয়। 

ভূমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সম্ভাব্য ব্যয় পাঠানোর ১ বছর ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও বেজা থেকে এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। এতে প্রকল্পটির কাজ পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখা হাজারো বেকার যুবক এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলা সীমান্তবর্তী সাপাহার উপজেলার খেড়ুন্দা মৌজায় সাপাহার-খঞ্জনপুর বিওপি ক্যাম্পের রাস্তার উত্তর পাশের্^ জাতীয় সড়ক, নদী, আকাশ পথ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাসহ যাবতীয় অবকাঠামো সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) ২৫৪ দশমিক ১৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয়। যাচাই বাছাই শেষে ওই মৌজার ২৫০ দশমিক ৬৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি জেলা প্রশাসককে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এর ১১ দিন পর আবারো ভূমি অধিগ্রহণে সম্ভাব্য ব্যয় জানতে জেলা প্রশাসককে আবারো চিঠি প্রেরণ করে বেজা। পরবর্তীতে সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ তারিখে ভূমি অধিগ্রহণের সম্ভাব্য ব্যয় হিসেবে ৭১ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বরাদ্দ চেয়ে জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে বেজাতে চিঠি প্রেরণ করা হয়।

জানা যায়, গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন-২০১০ এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা করে সরকার। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে বলে জানানো হয়।

ঘোষণার পর ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে নওগাঁ-১ (সাপাহার-পোরশা-নিয়ামতপুর) আসনের সাংসদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামসুল আলম শাহ চৌধুরী ও তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ফাহাদ পারভেজ বসুনীয়া সম্মিলিতভাবে সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জোর সুপারিশ পাঠায়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ‘সাপাহার অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপন প্রকল্পের নীতিগত অনুমোদন দিয়ে গত ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রস্তাবনায় আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী।

এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন হলে নওগাঁ জেলাসহ পার্শ¦বর্তী জেলাগুলোর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে আমদানি রপ্তানী বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে এ উপজেলার সাধারন মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে উপজেলার আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় উন্নয়নের জোয়ার বইবে। 

জেলার ঠাঁ-ঠাঁ বরেন্দ্র ভূমি হিসেবে পরিচিত সীমান্তবর্তী এই উপজেলা ২৪৪.৪৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনে ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। যেখানে প্রায় দুই লাখ মানুষের বসবাস। এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে এর আশেপাশে জেলার পোরশা, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা, ধামইরহাট, মহাদেবপুর উপজেলা এবং পাশর্^বর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। যেখানে সাপাহারসহ আশেপাশের উপজেলার হাজারো বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

সাপাহারের প্রধান অর্থকরি ফসল আম, ধান ও গম। পানির সমস্যা থাকায় এক সময় এ অঞ্চলে বছরের একটি মাত্র বৃষ্টি নির্ভর ফসল আমন ধানের উপর নির্ভর করতে হতো। তবে বর্তমানে ধানের ওপর নির্ভর না করে এ উপজেলার চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে ঝুঁকেছেন। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সাপাহার উপজেলা। সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় আদিবাসী এবং নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি থাকায় এক সময় এখানকার জনগোষ্ঠী শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে এ উপজেলা। এখানে অনার্স ও মাস্টার্সসহ সাপাহার সরকারি ডিগ্রী কলেজ, অনার্সসহ চাঁন মোহাম্মদ মহিলা ডিগ্রী কলেজ, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, জামাননগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। 

দুই বছর আগে যখন সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পের নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী সেখানে বেকার যুবকদের কর্মংসংস্থান হবে বলে জানিয়েছিলেন তখন এ উপজেলার হাজারো বেকার যুবকরা তাদের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে এখানে জুস কারখানা হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এ অঞ্চলের আম চাষিরা অতিরিক্ত আয়ের স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। জুস কারখানা হলে ওই অঞ্চলে সংরক্ষণাগারের অভাবে প্রতি বছর নষ্ট হওয়া কোটি টাকার আম বিক্রি করে লাভবান হবেন চাষীরা। এরই প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণার পর অনেক তরুন উদ্যোক্তা এ অঞ্চলে আম চাষে বৃহৎ অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তবে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন কাজের কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এখন তাদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১ সালে জেলায় ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিল। ২০২০ সালে ছিলো ২৪ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এরমধ্যে সাপাহার উপজেলায় ৮ হাজার ৫২৫ হেক্টর এবং পোরশা উপজেলায় ১০ হাজার ৫৫০ হেক্টর।

উপজেলার খঞ্জনপুর গ্রামের বাসীন্দা ইমরান হোসেন। খেড়ুন্দা মৌজায় তাদের দুই বিঘা ফসলি জমিতে আম বাগান করার ইচ্ছা ছিল। যেখানে আলু লাগিয়েছেন। 

ইমরান হোসেন বলেন, ‘গত কয়েক বছর থেকে শুনছি এ এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হবে। যেখানে বিভিন্ন শিল্প কারখানা তৈরি করা হবে। যার কারণে জমিতে আম বাগান করা হয়নি। এছাড়া আশপাশের জমির মালিকরাও কেউ আম বাগান করেনি। যদি আম বাগান করা সব গাছ নষ্ট হয়ে যাবে এবং আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে। এ কারণে জমির মালিকরা আলু, গম ও সরিষা লাগিয়েছে। তবে জমি অধিগ্রহণ করা হলে যেন ন্যায্য মূল্য দেওয়া হয়।’ 

সাপাহার উপজেলার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম, আমানউল্লাহ, সেলিম রেজা, রুবেল হোসেন, শাহরিয়ার ও এনামুল হকসহ একাধিক তরুন উদ্যোক্তা জানান, প্রতি বছর আমের মৌসুমে কয়েক হাজার তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় ক্রেতাদের কাছে আম পাঠানো হয়। সংরক্ষণাগারের অভাবে প্রতি মৌসুমেই অতিরিক্ত পাঁকা আম নাম মাত্র দামে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হয়। এতে লক্ষাধিক টাকা লোকসান গুনতে হয়। অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকলে এখানে কোম্পানীগুলো জুস কারখানা গড়ে তুলতো। জুসের পাশাপাশি আঁচারসহ সবকিছুই তৈরি হতো। এতে কোম্পানিগুলোর সাথে সরাসরি ব্যবসা করার একটি সুযোগ তৈরি  হবে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।

সাপাহার বরেন্দ্র এগ্রো পার্ক এর স্বত্ত্বাধিকারী ও তরুণ উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, কৃষি প্রধান জেলার মধ্যে সাপাহার উপজেলা আমের জন্য বিখ্যাত। এ উপজেলা আমের নতুন রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে যা নীতিগত ঘোষণা দুই বছর থেকে শুনছি। গত দুই বছরে কৃষিতে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। যেখানে কৃষিপণ্য আম, পেয়ারা, মাল্টা ও ড্রাগন প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু হবে। জেলায় বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মতো আম উৎপাদন হয়। এরমধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে কয়েক কোটি টাকার আম নষ্ট হয়ে যায়। এ আমগুলো যদি প্রক্রিয়াকরণ করা হয় তাহলে অর্থনীতিতে বড় একটা ভূমিকা রাখবে। এছাড়া কৃষি কেন্দ্রীক রপ্তানি পণ্য তৈরী করতে পারবো। আমরা চাই দ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা হোক। এতে হাজারো বেকারদের কর্মসংস্থান হবে এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এখানে কৃষি কেন্দ্রিক প্রায় তিন হাজার উদ্যোক্তা রয়েছেন।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সুমন জিহাদী বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণে আনুষাঙ্গিক খরচসহ সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি চিঠি নির্বাহী চেয়ারম্যান বেজাকে পাঠানো হয়েছে। বেজা থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দিলে বিষয়টি নিয়ে জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সাথে আলোচনার মাধ্যমে অনুমোদন দেয়া হবে। অধিগ্রহণে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।

নওগাঁ চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে ভাল একটা ভূমিকা রাখবে। কৃষিভিত্তিক জেলা ধান ও আমকে ব্র্যান্ডিং করে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠা একান্ত প্রয়োজন। বাহিরের দেশে ফলকে ফুড প্রসেসিং ও প্যাকেটজাত করে বছর জুড়ে খেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয়না। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে যখন বড় ব্যবসায়িরা এখানে শিল্প কারখানা গড়ে তুলবে তখন অর্থনৈতিক চাকা সচল হবে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার এটার বিষয়ে খুবই তৎপর রয়েছে। এছাড়া চেম্বার অব কর্মাস থেকে আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তবে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে কি অবস্থা দাঁড়াবে যা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।

নওগাঁ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, সাপাহার অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে জমির বিস্তারিত বিবরণ ও পূর্ণাঙ্গ তফসিলসহ বেজাতে পাঠানো হয়েছে। এরপর ওপর থেকে কোন অগ্রগতি আমাদের কাছে আসেনি। তবে এখানে কি ধরণের ইন্ডাষ্ট্রি হবে বা মানুষের কর্মসংস্থান হবে তার কোন তথ্য আমরা পাইনি। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি জীবনমান উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে আমদানি রফতানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।