Joy Jugantor | online newspaper

বগুড়ায় কোরবানির পশুর হাটে খাজনায় গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা 

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন

প্রকাশিত: ১৯:১৬, ৫ জুলাই ২০২২

আপডেট: ০৯:০৯, ৬ জুলাই ২০২২

বগুড়ায় কোরবানির পশুর হাটে  খাজনায় গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা 

জায়গা না থাকায় রাস্তার ওপর বসেছে বগুড়া সদরের সাবগ্রাম হাট।

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। কোরবানিদাতারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে পছন্দের পশুটি ক্রয়ে। কিন্তু হাটের খাজনা দিতে গিয়ে বিরম্বনার শিকার হতে হচ্ছে তাদের।

অভিযোগ উঠেছে, হাটের নির্ধারিত খাজনার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা দিতে হচ্ছে কোরবানির পশু ক্রেতাদের। এমনকি বিক্রেতাদের কাছে থেকে টাকা আদায় করছে হাট ইজারাদারেরা। 
শুধু তাই নয়, খাজনা আদায়ের রশিদে ইজারাদারেরা টাকার পরিমাণ উল্লেখ না করেই ক্রেতাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন।

তবে বগুড়া জেলা প্রশাসন জানিয়েছে কোরবানির হাটে বড় গরুর জন্য ৫০০, ছোট গরুর জন্য ৪০০ এবং ছাগল ও ভেড়ার জন্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

মঙ্গলবার ও সোমবার জেলার কয়েকটি হাট ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। বগুড়া সদর, শাজাহানপুর ও শিবগঞ্জের হাটগুলোতে এমন পরিস্থিতি চলছে।

ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর দ্বিতীয় দিনের মতো বসেছে সদরের সাবগ্রাম পশুর হাট। এর আগে শনিবার এখানে হাট বসেছিল। তবে এবার জায়গার সংকটের কারণে রাস্তার ওপর পশুর হাট বসেছে। 
ক্রেতারা পছন্দের গরু-ছাগল কিনে নিয়ে ফিরছে বাড়িতে। কিন্তু পশুক্রয়ের পর খাজনা দিতে গিয়ে চমকে উঠতে হয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।

দুপুর থেকে এ হাটে পশুসহ ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাট ইজারাদার প্রতি গরুর জন্য ক্রেতার কাছে থেকে এক হাজার টাকা খাজনা আদায় করছেন। আর বিক্রেতার কাছে ২০০ টাকা।
আর ছাগল কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। বিক্রেতার কাছে ইজারাদার আদায় করছে ১০০ টাকা।

জানতে চাইলে সাবগ্রাম হাটের ইজারাদার আব্দুল ওয়াহাব বলেন, খাজনার বেশি না নিয়ে উপায় নেই। এ হাটের মূল্য এক কোটি টাকা। হাটের জায়গা নেই। গরু-ছাগলের হাট লাগে না। শুধু ঈদের সময় এই হাট লাগে। টাকা বেশি না নিলে ইজারার টাকা কেমনে উঠবে।

মঙ্গলবার শাজাহানপুরের দুবলাগাড়ী হাটে খোঁজ নিয়ে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের তথ্য পাওয়া যায়। এ হাটে প্রতিটি গরুর জন্য ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আদায় করছিলেন ইজারাদারের প্রতিনিধিরা। আর ছাগল-ভেড়ার ক্ষেত্রে নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। কিন্তু রশিদের কোথাও টাকার কথা উল্লেখ নেই।

অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের কারণ জানতে চাইলে রুহুল আমিন নামে ইজারাদারের এক প্রতিনিধি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, হাটে কারও কাছে থেকে বেশি খাজনা নেয়া হচ্ছে না।

পরে শাজাহানপুর ইউএনও আসিফ আহমেদ পরিদর্শনে গিয়ে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের অভিযোগ পান। ঘটনার সত্যতা পেয়ে ইজারাদারকে সতর্ক করেন। 

উপজেলার বামুনিয়া গ্রামের আতিকুর রহমানের কাছেও এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। তিনি ৮৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু ক্রয় করেন। খাজনা দিতে গেলে তার কাছে ৮০০ টাকা দাবি করেন ইজারাদারের এক প্রতিনিধি। পরে ইউএনওর উপস্থিতিতে ৫০০ টাকা খাজনা পরিশোধ করেন আতিকুর।

আতিকুর বলেন, কিন্তু আমার কাছে ওরা দাবি করে ৮০০ টাকা। ইউএনও হাটে এসে সতর্ক করার পর হাট ইজারাদারের লোকজন আমার কাছে ৫০০ টাকা নেন।

এ বিষয়ে ইউএনও আসিফ আহমেদ বলেন, দুবলাগাড়ী হাটে নির্ধারিত টোলের চেয়ে বেশি আদায় করা হচ্ছিল। পরে হাটের সবাইকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিই।

শিবগঞ্জ উপজেলায় সরকার নির্ধারিত ১৪টি পশুর হাট আছে। মঙ্গলবার উপজেলার আলিয়ার হাটের কোরবানির ঈদের পশুর হাটে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করছে ইজারাদার। 

গরু কিনতে আসা উপজেলার বাদলাদীঘি গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস জানান, প্রতি গরুতে সরকারি খাজনা ৫০০ হলেও নেওয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। ক্রেতা দিচ্ছে ৫০০ টাকা এবং বিক্রেতারা দিচ্ছে ১০০ টাকা। 

আলিয়ারহাট পশুর হাটের ইজারাদার জাহিদুল বলেন, সরকার নির্ধারিত খাজনার বাহিরে কোন টাকা নেওয়া হচ্ছে না। ক্রেতা বিক্রেতারা যাতে প্রতারিত না হন সেজন্য মাইকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং পুলিশ নিয়োজিত রয়েছেন। 

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে কুলসুম সম্পা বলেন, আলিয়ারহাট পরিদর্শন করা হয়েছে। খাজনা আদায়ের বইয়ে টাকার পরিমাণ লিখতে বলা হয়েছে। কোনো অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এর আগের দিন সোমবার ছিল শহরের বনানী এলাকায় সুলতানগঞ্জ হাট। এই হাটেও একই অবস্থা। ক্রেতাদের কাছে থেকে হাট ইজারাদার প্রতিটি গরুর জন্য এক হাজার টাকা এবং ছাগল-ভেড়ার জন্য ৫০০ টাকা আদায় করছে। আর বিক্রেতাদের কাছে গরুর জন্য ২০০ টাকা এবং ছাগল-ভেড়ার জন্য ১০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। ছোট-বড় সব গরুর ক্ষেত্রেও একই খাজনা আদায় করা হচ্ছে। 

গরু কিনে ফেরার সময় এ বিষয়ে কথা হয় বগুড়া শহরের কলোনী চকফরিদ এলাকার জামিল মকদুমের সঙ্গে। 

তিনি বলেন, গরু কিনেছি এক লাখ টাকায়। আর ছাপার (খাজনা) খরচ দিতে হয়েছে এক হাজার টাকা। আসলে এই খাজনার মূল্য ৫০০ টাকা। কিন্তু হাটের লোকজন জুলুম করে এক হাজার টাকা নিয়েছে। ওরা জবরদস্তি করলে কি করার আছে?

তার কাছে গরু বিক্রি করেন ধুনটের ফটিক। তিনি বলেন, গরু বিক্রি করার জন্য আমাকেও ২০০ টাকা দিতে হয়েছে। 

ছাগলের হাটের অংশে গিয়েও দেখা যায় অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের চিত্র। এখানে ছাগল  প্রতি খাজনা নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। ছিলিমপুর ইসলামপুর এলাকার সাকিব জানান, ছাগল কিনেছি সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে। আর খাজনা দিলাম ৫০০ টাকা। একই সাথে ছাগল বিক্রেতা দিল ১০০ টাকা।

নাম প্রকাশে অপারগ হাটের এক খাজনা আদায়কারী অতিরিক্ত টাকা বিষয়টি জানান। ইজারাদারের এই প্রতিনিধি জানান, ক্রেতার জন্য গরু হলে এক হাজার আর ছাগল হলে ৫০০ টাকা। 

এই হাটের ইজারাদারের নাম সাজেদুর রহমান সাহিন। কিন্তু পশুর খাজনা অতিরিক্ত নেয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে তাকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু সংযোগ না পাওয়ায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। 

গত ২৭ জুন বগুড়া জেলা প্রশাসন থেকে কোরবানির হাটের ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পশু বাঁধার খুঁটি স্থাপন এবং নির্ধারিত রেইটে টোল আদায় নিশ্চিতকরণ । কিন্তু হাটগুলোয় এসব নিয়ম মানার কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি।

কোরবানির হাট শুরু হওয়ার পর থেকে এমন অনিয়ম হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা হাট পরিদর্শনের গিয়ে অভিযোগ পাওয়ার পরেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি। 

কোরবানি পশুর ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে জানতে চাইলে বগুড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক  (রাজস্ব) উজ্জল কুমার ঘোষ জানান, হাটের খাজনা আদায়ে টাকার মূল্য অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে। সরকার পশুর খাজনা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বড় গরুর ক্ষেত্রে এই মূল্য হবে ৫০০ টাকা। ছোট গরুর জন্য ৪০০ এবং ছাগল-ভেড়ার জন্য ১৫০ টাকা। 
তবে কোরবানির হাটের দায়িত্বে না থাকায় এর বেশি কিছু বলতে চাননি উজ্জল কুমার ঘোষ।

কোরবানির হাটের অনিয়ম নিয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, আপনার অভিযোগটি শুনলাম। আমি সকল ইউএনওদের বিষয়টির ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলে দিচ্ছি। 

প্রতিবেদন সহায়তায়: মামুনুর রশিদ মামুন, মিজানুর রহমান, রবিউল ইসলাম।