বগুড়ার সারিয়াকান্দি চন্দনবাইশা ইউনিয়ন এলাকায় যমুনার নদীর পানিতে ডুবে গেছে বাড়িটি। বুধবার সকালে তোলা।
গেদুনি বেগমের বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে। মাস পাচেক আগে তার স্বামী মারা গেছেন। এখন থাকেন একমাত্র ছেলে শাহীনুরের সংসারে। এর মধ্যে উজানের ঢলে বন্যা এসে বিপত্তি বাধিয়েছে। যমুনা নদীর চরে ছেলের বাড়ি ডুবেছে পানিতে। ছেলে সব ফসলও বানের পানিতে পচে যাচ্ছে।
বানভাসী এসব মানুষের মাঝে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। তবে গেদুনির ভাগ্যে ত্রাণে জোটেনি। এই বৃদ্ধার ভাষ্য, ‘জীবনের শেষ বেলায় এসে শুনতে হচ্ছে, সরকারি দানের খাবার পেতেও নাকি দল করা লাগে। প্রভাবশালী হওয়া লাগে। আমরা দলও করিনা, প্রভাবশালীও নই। এই কারণে ত্রাণের চাল আমাদের ভাগ্যে বরাদ্দ নেই।’
গেদুনি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চর বাটিকার বাসিন্দা। যমুনা নদীর অন্য আরেক চর ভেঙে এখানে স্বামীর সাথে সংসার গড়েছিলে বছর দশেক আগে। এখন সেখানেই থাকছেন। তবে এখন পরিবেশ বদলেছে বলে মনে হচ্ছে তার। এবার বানভাসীদের জন্য এই চরে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে গত মঙ্গলবার। জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে ত্রাণ বিতরণ করেন।
ত্রাণ বিতরণের সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা খুব আন্তরিক হলেও স্থানীয় নেতাদের কারণে গরীব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে দাবি গেদুনির। গেদুনির কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, চর বাটিকায় মঙ্গলবারের অনেকেই ত্রাণ পায়নি। যারা পেয়েছেন তারা স্থানীয় নেতাদের নেতাদের পরিচিত কিছু মুখ।
গেদুনির ছেলে শাহীনুর এবার তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। সোনালি এই ফসল এখন পানির নিচে। শাহীনুর বললেন, ‘ঋণ করে বর্গা নেওয়া জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। এখন ঋণের বোঝা কীভাবে শোধ করব, আর সংসারই-বা কীভাবে চলবে?’
শাহীদের এমন করুণ প্রশ্নের মধ্যেই চরবাটিকায় নিজ ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলা শুরু করলেন আসাদুল মন্ডল। তার ছয় মেয়ের মধ্যে পাঁচজনকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন আসাদুলের সংসারে এক মেয়ে। সারিয়াকান্দির একটি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বন্যারে কারণে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আসাদুল বলেন, ‘আমাদের মতো গরীব মানুষের লেখাপড়া ও খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই। সরকারি যা ত্রাণ আসবে সব বড়লোক আর দলীয় নেতাদের বাড়িতে ঢোকে। এগুলো কথা শোনার কেউ নেই। এখন আল্লাহর উপর ভরসা ছাড়া আর কিছু দেখি না।’
বুধবার আসাদুলের সাথে আলাপাকালে তার স্ত্রী মর্জিনা ঘরের দরজায় মাটির চুলায় রান্না করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সংসারের ছয়মাস পাটের টাকায় চলে। কিন্তু এবার পাট পানিতে পঁচে যাচ্ছে। পাট চাষের সময় একবার দেনা (ঋণ) করতে হয়েছে। এবার আরও দ্বিগুণ দেনা করতে হবে।’
বাটিকার চরে অনেকেই ত্রাণ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, চর বাটিয়া প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস। এখানে মঙ্গলবার প্রথম ধাপে ১০০ মানুষের মাঝে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাই ত্রাণ পাবে। কারও কোনো দিক বিবেচনা করে ত্রাণ দেওয়া সুযোগ নেই।
উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে বগুড়ার যমুনা নদীর পানি বুধবার দুপুরে বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরকারি হিসাবে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো তা বিপদসীমার উপরে। পার্শ্ববর্তী বাঙালী নদীতেও পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান জানান, যমুনা নদীর পানি সমতল সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপদসীমার বুধবার দুপুরে ৬৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সম্পর্কে এর আগে সারিয়াকান্দি উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুর রহমান বলেন, কামালপুর ইউনিয়নে সমস্যা বেশি। এই এলাকার প্রায় ৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুকিঁপূর্ণ। আমরা এসব এলাকা নজরদারিতে রেখেছি।
চলতি মাসের প্রথম থেকে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। উজানে বৃষ্টি হওয়ার কারণে এই পাহাড়ী ঢল ভাটি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। এর আগে গত ১৭ জুন সন্ধ্যা থেকে যমুনায় পানি বিপৎসীমার ওপরে বইতে শুরু করে। এতে সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের ১১টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল পানিতে ডুবেছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দির অন্তত ৬০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, এবার বন্যায় কারণে বগুড়ার ৫০ প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমির ফসল। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুরের মাছ।