Joy Jugantor | online newspaper

অসময়ে তরমুজ চাষে সফল নীলফামারীর ৩ কৃষক

নীলফামারী প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১:২৪, ২৯ মে ২০২৩

অসময়ে তরমুজ চাষে সফল নীলফামারীর ৩ কৃষক

ছবি সংগৃহীত

দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে মাচায় ঝুলছে লাউ-কুমড়া। কিন্তু কাছে গিয়ে একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে সেগুলো লাউ বা কুমড়া নয়। মাচায় জাল দিয়ে মোড়ানো ব্যাগের ভেতরে ঝুলছে হলুদ-সবুজ-ডোরাকাটা রসালো তরমুজ। অসময়ে উৎপাদিত তরমুজ চাষ করে সাড়া ফেলেছেন নীলফামারীর তিন কৃষক। কৃষি বিভাগের সহায়তায় গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করে প্রথমবারেই সাফল্য পেয়েছেন কৃষকরা। ফলে অনেক কৃষকই এই তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র মতে, নীলফামারী জেলা শীতপ্রধান হওয়ায় জেলার কোথাও স্বাভাবিক সময়ে তরমুজ চাষ করেন না কৃষক। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে এ অঞ্চলের আবহাওয়া এবং মাটি উপযোগী। দেশের অন্যান্য জেলায় স্বাভাবিকভাবে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম পর্যন্ত তরমুজের বীজ রোপণ করা হয়। কিন্তু নীলফামারীতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে তরমুজের বীজ রোপণ করা হয়। কৃষি বিভাগের অনুপ্রেরণায় এবার সদরের উপজেলার তিনজন কৃষক ৩৪ শতাংশ জমিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করেছেন।

জেলায় প্রথমবারের মতো তরমুজ চাষ করা তিন কৃষকের মধ্যে অন্যতম কানিয়ালখাতা গ্রামের কৃষক সামছুল হক (৩৫)। নিজের কৃষি জমি ২৬ শতক হলেও বাৎসরিক চুক্তি নিয়ে চার বিঘা জমিতে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ফলান তিনি। এবার ১৫ শতক জমিতে চাষ করেছেন গ্রীষ্মকালীন তরমুজ। জমিতে চারা রোপণের ৭৫ দিনে অসংখ্য তরমুজের দেখা মিলেছে তার ক্ষেতে। জেলায় পরীক্ষামূলক চাষে এমন সফলতা সাড়া ফেলেছে এলাকায়। ফলে ব্যাপক লাভের আশা করছেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, ক্ষেতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মাচা। সেই মাচায় অসংখ্য ছোট বড় তরমুজ ঝুলে আছে। তরমুজগুলোর রং বাহারি। কোনোটির গায়ে ডোরাকাটা দাগ, কোনোটি হলুদ, কোনোটি আবার কালচে-সবুজ।

কৃষক সামছুল হক বলেন, আমি প্রতিবছর বেগুন, পটোল, ঢ্যাঁড়স ও মিষ্টিকুমড়াসহ অন্যান্য শাকসবজির আবাদ করি। এই বছর প্রথম ১৫ শতাংশ জমিতে তরমুজের আবাদ করেছি। চাষ করার পর কৃষি অফিস থেকে এসে আমার চাষাবাদে পরামর্শ দেন কর্মকর্তারা। আমি শুধু একটু শ্রম দিছি। আমার এখানে কোনো রোগবালাইও নাই, ফলনও ভালো আছে। ১৫০টা তরমুজ গাছ রয়েছে। এতে ৬০০ এর বেশি তরমুজ আছে।

তিনি আরও বলেন, আমি মাত্র খরচ করেছি ১৬ হাজার টাকা। ভালো লাভ আসবে আমার। অনেক কৃষক জিজ্ঞেস করতেছে এটা তুই কোনটে (কোথায়) পাইছিস আমরাও করবো। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখার জন্য সবাই আসতেছে। আগামী বছর আমি বাড়ির কাছে চাষ করব। এবার তো অল্প করেছি, বাড়ির কাছে এক বিঘা জমি তরমুজ চাষ করব। আমি আশা করছি ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো লাভ হবে।

একই গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিম বলেন, আমি কৃষি কাজ করি। বেগুন, ঢ্যাঁড়স, বরবটিসহ অন্যান্য সবজি চাষ করি কিন্তু সামছুল ভাই যে তরমুজ নিয়ে আসছে এটা কিন্তু আমার চোখে জীবনেও দেখি নাই। আমি দেখছি নিচু মাটিতে তরমুজ হয় এখানে দেখতেছি মাচায়। তা দেখতেছি খুবই ফলন হইছে। আর এখনই একটার তিন থেকে চার কেজি ওজন হবে। আমি সামছুল ভাইকে বলছি ভাই কোথায় থেকে পাইছিস আমি এক বিঘা জমিতে চাষ করব। ভাই নাকি কৃষি অফিস থেকে সব পাইছে। আমিও কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাষ করব।

কৃষক দুলাল হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় নতুন একটা সবজি চাষ হয়েছে, এটা আমরা আগে চাষ করিনি। আমাদের বিভিন্ন রকমের সবজির চাষ হলেও এই প্রথম তরমুজ চাষ হয়েছে। এলাকায় তরমুজ চাষ হয়েছে বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ দেখতে আসতেছে।

নীলফামারী পৌরসভার হাড়োয়া জাফরাবাদ মহল্লার নুরীন নূর ওরফে মুক্তা বলেন, আমার জায়গাটা পড়েছিল। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাকিবের কাছে আমি জানতে পারলাম তরমুজের বীজ এখানে রোপণ পারি। তারপর আমি আমার এই পতিত জায়গাটায় ব্লাক বেরি ও তৃপ্তি জাতের তরমুজের বীজ রোপণ করি। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ভালো ফলন এসেছে। আমি চিন্তা করছি আগামীতে আমার আরও অনেক জমি আছে, সেখানে আমি এই তরমুজ চাষ করব। অনেকে আসছে এই তরমুজ দেখতে, যারা আসছে দেখার পর তারা জানতে চাচ্ছে আমি কীভাবে এটা পেলাম, কীভাবে রোপণ করলাম। কীভাবে যত্ন নিলাম এগুলো জানতে চাচ্ছে। আমি তাদের বলছি, তাদের সহযোগিতা করছি তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে যে, তারা এই তরমুজ চাষ করবে।

এ বিষয়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এস এম রাকিব আবেদীন বলেন, আমার কর্মরত পৌরসভা ব্লকে ৭ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক এ তরমুজ চাষ করা হয়েছে। চাষ করে যেটি দেখতে পেলাম, আমাদের এই পৌরসভা ব্লকে আবহাওয়া ও মাটির যে গুনাগুন এতে এই তরমুজগুলো ভালো চাষ করা যাবে। আমরা যারা লাউ-কুমড়া চাষ করি তারা কিন্তু সহজেই তরমুজ চাষ করতে পারবো। যেহেতু একই পরিবারের ফসল এগুলো, একই ধরনের পোকার আক্রমণ ও রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখানে যদিও কোনো রোগ হয়নি কিন্তু মাছি পোকার আক্রমণ খুব বেশি হয়েছে। একদম নিরাপদ পদ্ধতিতে ফ্যারামণ ট্যাপ ও ব্যাগিং করা হয়েছে। শুধু এগুলো করা হয়েছে পোকার জন্য। কিন্তু আমরা কোনো কীটনাশক ব্যবহার করিনি। আমি বলতে পারি আমার এই ব্লকে এই তরমুজটি অনেক ভালো চাষ হবে এবং ভবিষ্যতে আমি এটি অবশ্যই সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করবো।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক আহমেদ বলেন, আমরা নীলফামারী সদর উপজেলায় প্রথমবারের মতো গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করেছি। তিনজন উদ্যোমী কৃষকের মাধ্যমে এই তরমুজ চাষ করেছি। এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা আছি এবং বীজ, সারসহ অন্যান্য খরচ আমরা দপ্তর থেকে দিয়েছি। গ্রীষ্মকালীন তরমুজ সারাদেশে লাভজনক ফসল, আমরা দেখতে চাচ্ছি কৃষকেরা এই অঞ্চলের মাটি চাষ করতে পারছে কিনা। কীভাবে কৃষকদের লাভবান করা যায় সেটা আমরা দেখছি। যেহেতু নীলফামারীতে আগে তরমুজ চাষ হয়নি এখন বর্তমানে যা দেখছি খুব ভালো অবস্থা। কৃষকও সন্তুষ্ট আছে। সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের কৃষক শামছুক হক তার ওখানে ১৫ শতক জমিতে তরমুজের চাষ করেছে।  হিসেব করে দেখলাম প্রতিটি গাছে চারটি করে তরমুজ ধরে এবং প্রতি তরমুজ যদি তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজন হয় তাহলে এই তরমুজটা প্রায় এক লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবে। এই তরমুজ স্বল্পমেয়াদী ফসল হওয়ায় ৮০ থেকে ৯০ দিনের মাথায় হারভেস্ট করা যায়।

তিনি বলেন, ৯০ দিনে একটা জমি থেকে ৮০ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে। বিকল্প হিসেবে এ তরমুজটি যেনো মাঠে আসতে পারে সেজন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে এই তরমুজ চাষ করিয়েছি। এখন মাঠের অবস্থা সন্তোষজনক। আমরা আশাবাদী চার থেকে পাঁচদিনের মধ্যে মাঠ থেকে বাজারে তোলা সম্ভব হবে এসব তরমুজ। আমরা ওই কৃষককে ফল ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছি, যাতে তিনি সহজেই বিক্রি করতে পারেন। আমরা খুবই আশাবাদী সে ভালো দাম পাবে। আমরা মনে করছি, তার এই লাভ দেখে তার এই সফলতা দেখে সদর উপজেলাসহ নীলফামারীতে এই তরমুজ চাষের প্রসার ঘটবে।